এক অন্যরকম উত্তরপত্র

Friday, 7 April 2017

বাংলা বানানের নিয়ম - ধ্বনিতত্ব

বাংলা বানানের নিয়ম

বানান
সংস্কৃত বর্ণন থেকে বানান এসেছে যার অর্থ শব্দের মধ্যকার বর্ণসমূহের বিশ্লেষণ বা ক্রমিক বর্ণন (বর্ণ+ অন)। শব্দের উৎপত্তি, অর্থ ও গঠন অনুসারে শব্দের প্রমিত লিখিতরূপকে বানান বলে। Spellingisthe act of namingthe letters of words অর্থাৎ বানান হলো শব্দে অবস্থানরত বর্ণের লিখিত নিয়ম। শব্দ বিভিন্ন ভাষা থেকে আসে বলে বানান মনে রাখা কষ্টসাধ্য। বানান একটি পদ্ধতি তাই সতর্কতার সঙ্গে পাঠ করে মনে রাখতে হয়। বানানের নির্দিষ্টরূপ দেয়া যায় না বলে বানানকে ‘শুদ্ধ বানান’ না ডেকে ‘প্রমিত বানান’ ডাকা হয়। শব্দের মূল উচ্চারণ, ধ্বনিব্যবস্থার গঠনরীতি অনুসারে লিখিত বানানকে প্রমিত বানান বলে। প্রথম প্রমিত বানান ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে। আর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে এবং বাংলা একাডেমি ১৯৯৪ সালে।
বানান প্রকরণ
বর্তমানে বাংলা ভাষার প্রচুর শব্দভাণ্ডার তা একদিনে নয়, অনেক কাল-অনেক শতাব্দী ধরে জড়ো হয়েছে। এসব শব্দ এসেছে-অস্ট্রিকভাষা, দ্রাবিড়ভাষা, আর্য বা বৈদিকভাষা, সংস্কৃতভাষা, পালিভাষা, প্রাকৃতভাষা, অপভ্রংশভাষা, দেশিভাষা, আঞ্চলিকভাষা, প্রাদেশিকভাষা, বিদেশিভাষা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। বৈদিক ভাষার সংস্কার করার পর হয় সংস্কৃতভাষা। সংস্কৃতভাষা সংস্কার হলে সেটি হয় সাধুভাষা। সাধুভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রেখে আমরা পেয়েছি চলিতভাষা। এই যে ধারাবাহিক পরিবর্তন তা বহু বছরের, বহু কালের। শব্দের বানান দুইভাবে নির্ধারণ করা যায়। যেমন :
ক) শব্দের উৎপত্তিগত বানান : শব্দের উৎপত্তি অনুসারে শব্দের বানান নির্ধারণ করা যায়। যেমন:
১. সংস্কৃত শব্দ: সংস্কৃত শব্দ হুবহু সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে বলে এর বানানের কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন: গাত্র, কৃষ্ণ, গৃহিণী, মস্তক, হস্ত, কর্ণ, বৃক্ষ, মৎস্য, স্বর্ণ ইত্যাদি।
২. খণ্ডসংস্কৃত শব্দ: সংস্কৃতজাত শব্দ কিছুটা পরিবর্তন হয়ে খণ্ডসংস্কৃত শব্দ হয়েছে বলে এর বানানের পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: গতর, কেষ্ট, গিন্নি, মাথা, হাত, কান, গাছ, মাছ, সোনা ইত্যাদি।
৩. তদ্ভবশব্দ: সংস্কৃতজাত শব্দ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে তদ্ভব শব্দ হয়েছে বলে এর বানান পরিবর্তন হয়ে যায়। তদ্ভব শব্দের বানান একেবারে খাঁটি দেশি শব্দের মতো। যেমন: হস্ত>হত্থ>হাত, চন্দ্র>চন্দ>চাঁদ, ঈ-কার হয়ে যায় ই-কার। ঊ-কার হয়ে যায় উ-কার। ণ-হয়ে যায় ন। য-ফলা থাকে না। যেমন: বৈশাখী>বোশেখি, কুম্ভীর>কুমির, সূর্য>সুয্যি /সুজ্জি, স্বর্ণ>সোনা, বর্ণ>বরন, কৃষাণ>কিষান, সন্ধ্যা>সন্ধে।
৪. আঞ্চলিক শব্দ: আঞ্চলিক শব্দ অঞ্চলজাত শব্দ বলে এর বানান পুরোটাই পরিবর্তন হয়। যেমন: হাত>ড্যানা, ষাঁড়>হাড় ইত্যাদি।
৫. দেশি শব্দ: বাংলা আদি শব্দ তাই এর বানান তার নিজের মতো। যেমন: কুলা, চুলা, কুড়ি, পেট।
৬. প্রাদেশিক শব্দ: সংস্কৃত বাদে ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষা থেকে এসেছে বলে এর বানান পুরোটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: হিন্দি: কাহানি>কাহিনি, ঠান্ডি>ঠান্ডা। গুজরাটি: হটতাল>হরতাল। তামিল: গুরুট>চুরুট।
৭. বিদেশি শব্দ: বিদেশি শব্দের বানান পুরোটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। সব সময় সব বানানে ই/উ-কার বসে। ঙ/ছ/ঞ্জ/ঞ্চ/ণ/ণ্ট/ণ্ড/ষ্ট না বসে ং/স/শ/ নজ/নচ/ন/ন্ট/ ন্ড/স্ট বসে। যেমন: ফেরেস্তা, স্কুল/কলেজ, আঁশ, জানালা, সাবান, টেক্কা, কাঁচি, লাশ, চা, চিনি, রিকশা, লুংগি, ডেংগু, ঝান্ডা, লন্ঠন, মিসরি (মিছরি), পসন্দ (পছন্দ), তির (ধনুক), ইনজিনিয়ার, সেনচুরি, ব্যাংক, ইনজিন, সেনচুরি, এন্ড, খ্রিস্টার্ন, স্টল, স্টেশন, স্টোর।
৮. পারিভাষিক শব্দ: পারিভাষিক শব্দ শব্দের কার্য, গুণ, স্বাদ ইত্যাদি অনুসারে বিদেশি শব্দ থেকে আগত বলে এর বানান সংস্কৃত বা তদ্ভব অনুসারে হয়ে থাকে। যেমন: পাঠ্যসূচি/ Syllabus, আইন/Act।
খ) শব্দের গঠনগত বানান : শব্দের গঠন অনুসারে শব্দের বানান নির্ধারণ করা যায়। যেমন:
১. সন্ধিযোগে: বর্ণ সংযোগে বা লোপে শব্দ গঠিত হয়। যেমন: বিদ্যালয় (বিদ্যা+আলয়), রবীন্দ্র (রবি+ ইন্দ্র), কটূক্তি (কটু+উক্তি)।
২. সমাসযোগে: দুই বা অধিক শব্দযোগে শব্দ গঠিত হলে এদের বানান তেমন পরিবর্তন না হলেও শুধু মাঝের ঈ-কার ই-কারে পরিণত হয়। যেমন: প্রাণিজগৎ, প্রাণিবিদ্যা, শ্রেণিকক্ষ, নারিচিহ্ন, মন্ত্রিসভা। আবার হাইফেন দিয়ে বা না দিয়েও লেখা যায়। যেমন: ছেলে-মেয়ে/ছেলেমেয়ে, কুসুমের মতো কোমল/কুসুমকোমল, মনরূপ মাঝি/মনমাঝি, শহিদদের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত মিনার/শহিদমিনার।
৩. উপসর্গযোগে: যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নাই তবে অন্য শব্দের আগে বসে নতুন শব্দ গঠন করতে পারে। এদের বানান অপরিবর্তিত থাকে। যেমন: আগাছা (আ-গাছা), নিখুঁত, নীরব, প্রধান, পরাজয় ইত্যাদি।
৪. প্রত্যয়যোগে: যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নাই তবে অন্য শব্দের পরে বসে নতুন শব্দ গঠন করতে পারে। এদের বানান অপরিবর্তিত থাকে। যেমন: বোকামি (বোকা+আমি), ডুবুরি (ডুব+উরি), মাধুর্য (মধুর+য), দৈন্য (দীন+য)।
৫. বিভক্তিযোগে: যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নাই তবে অন্য শব্দের (ধাতু ও নামশব্দ) পরে বসে নতুন শব্দ গঠন করতে পারে। যেমন: হাতা (হাত+অ), করব (কর+ব), গাইছি (গাই+ছি), রহিমরা (রহিম+রা)।
বানানের সমস্যা
বিভিন্নভাবে বানান প্রমিত হয় না। যেমন :
১. শব্দের উৎপত্তি ও গঠন সম্পর্কে না জানা
২. কার, ফলা, রেফ না জানা
৩. যে যার মতো যুক্তি দিয়ে শব্দের বানান লেখা
বাংলা প্রমিত বানানের নিয়ম
১. সকল প্রাদেশিক ও বিদেশি শব্দে ঈ-কার না বসে ই-কার বসে। যেমন: শুমারি, আমদানি, খানদানি, খুশকি, খুশি, বন্দি, জংগি, জমি, জরি, জামদানি, জিনজির, জিন্দাবাদ, জিন্দেগি, দরজি, দাগি, বিরিয়ানি, মুরগি, আবির, আমিন, আসামি, গরিব, কেরানি, দাদি, নানি, চাচি, ফুপি, মাসি, ভাবি, কাহিনি, কোম্পানি, জানুয়ারি, সেনচুরি, চৌধুরি, লুংগি।
২. বিদেশি শব্দে ঙ/ছ/ ঞ্জ/ঞ্চ/ণ/ণ্ট/ণ্ড /ষ্ট না বসে ং/স/শ/ই/ নজ/ নচ/ন/ ন্ট/ন্ড/স্ট বসে। যেমন: লুংগি, ডেংগু, ব্যাংক, স্যাম, ইনজিন, সেনচুরি, স্টার্ন, এন্ড, ঝাণ্ড/ ঝান্ডা, লন্ঠন, স্কুল, খ্রিস্টার্ন, স্টল, স্টেশন, স্টোর।
৩. ক্রিয়া, সংখ্যাবাচক, বিদেশি, প্রাদেশিক ও তদ্ভব শব্দে সব সময় ই-কার বসে। যেমন: আসুন, বসুন, করুন, শুনুন, হাসুন, বসুন, বাসুন, কাঁদুন, ভাবুন, দুই, কুড়ি, একুশ, চুয়ান্ন, চুয়াত্তর, চুরাশি, চুরানব্বই, নুন, রজু, রুহু, মুলো, তুলো, সুয্যি, ধুলো।
৪. কি: যার উত্তর হ্যাঁ/না-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ অর্থাৎ সম্মতিজ্ঞাপন প্রশ্নে ‘কি’ বসে। হ্যাঁ/না বোঝাতে ‘কি’ বসে। যেমন: তুমি কি খাবে? এই কি’র উচ্চারণ সংক্ষিপ্ত হবে। যেমন : হ্যাঁ/না। কি সর্বনাশ, কি জ্বালা।
কী: যার উত্তর বিষয়ের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ বিষয়জ্ঞাপন প্রশ্নে ‘কী’ বসে। ইংরেজি Wh (Who, What, Which, When, Where, How) দিয়ে প্রশ্ন করা হলে ‘কী’ বসে।। নির্দিষ্ট করে জানার জন্য কী, কোন, কোন উপায়ে, কবে, কেমন, কত, কোথায়, কখন, কিভাবে, কিসের জানতে চাইলেও কী ব্যবহৃত হয়। আবেগ/সন্দেহ /বিস্ময় /লজ্জা/ঘৃণা/সন্দেহ বোঝাতে ‘কী’ বসে। কী টেনে উচ্চারণ করতে হয়। যেমন: তুমি কী খাবে?—ভাত। What is your name? /Who are you? /Where will you go?/তুমি কী খাও?/এই কী’র উচ্চারণ দীর্ঘ হবে—ভাত। কী পড়—বই না পেপার। কী আশ্চর্য! কী সুন্দর! রবীন্দ্রনাথের জন্ম কী ১৮৬২ সালে?
৫. ক্রিয়াবাচক শব্দে সব সময় ই-কার বসে। যেমন: করি, মারি, ধরি, ভরি, চরি, পড়ি, পরি, চলি, বলি, ধরি, ভাবি।
৬. জাতির ভাষা শব্দে ই-কার বসে। যেমন: দেশি, বিদেশি, বাঙালি, বাংলাদেশি, জাপানি, ইরাকি, আরবি, ফারসি, ইংলিশ, হিন্দি।
৭. সন্ধিজাত শব্দে ঈ-কার বসে। যেমন:
ই+ই=ঈ      : রবীন্দ্র (বরি+ইন্দ্র), অভীষ্ট, অতীষ্ট, অধীন, অতীব, অতীত।
ই+ঈ= ঈ     : প্রতীক্ষা (প্রতি+ঈক্ষা), পরীক্ষা, সমীক্ষা, ক্ষিতীশ, মনীশ।
ঈ+ই=ঈ      : রথীন্দ্র (রথী+ইন্দ্র), সতীন্দ্র, সুধীন্দ্র, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র, মহীন্দ্র।
ঈ+ঈ=ঈ      : শ্রীশ (শ্রী+ঈশ), দিল্লীশ্বর, অবীনশ্বর, মহীশ।
৮. সন্ধিজাত শব্দে ঊ-কার বসে। যেমন:
উ+উ=ঊ     : কটূক্তি (কটু+উক্তি), সাধূক্তি, গুরূপদেশ, অনূদিত, মরূদ্যান, বধূদয়।
উ+ঊ=ঊ     : লঘূর্মি (লঘু +ঊর্মি), সিন্ধূর্মি, অনূর্র্ধ্ব, তনূর্র্ধ্ব, বহূর্র্ধ্ব।
ঊ+উ=ঊ     : বধূৎসব (বধূ+উৎসব), ভূত্থিত, বধূক্তি কিন্তু মধু+উৎসব ‘মধূৎসব' হবে না।
ঊ+ঊ= ঊ    : ভূর্ধ্ব, (ভূ+ঊধ্ব), সরভূর্মি।
৯. উপসর্গজাত শব্দে ই/ঈ-কার বসে। যেমন:
নিঃ+র হলে ঈ-কার হয় : নীরস (নিঃ+রস), নীরক্ত, নীরব, নীরোগ।
নিঃ+অন্যবর্ণ ই-কার হয়     : নির্গমন (নিঃ+গমন), নির্ধন, নির্জীব, নির্ভয়।
নিঃ+অ/আ থেকে ‘র’ হলে ই-কার হয়: নি অপরাধ (নিঃ+ অপরাধ), নিরবধি, নিরাকুল, নিরাভরণ, নিরাশ্রয়, নিরাপদ।
১০. একক শব্দর সমাসবদ্ধ শব্দে ঈ/ই-কার বসে। যেমন:
ঈ>ইত্ব : একাকী>একাকিত্ব, কৃতী>কৃতিত্ব, দায়ী>দায়িত্ব, মন্ত্রী>মন্ত্রিত্ব, স্থায়ী>স্থায়িত্ব।
ঈ>ইতা : উপকারী>উপকারিতা, উপযোগী>উপযোগিতা, প্রতিযোগী> প্রতিযোগিতা।
ঈ>ইনী : অপকারী> অপকারিনী, অভিমানী> অভিমানিনী, সঙ্গী>সঙ্গিনী।
ঈ>ই  : প্রাণী>প্রাণিবিদ্যা, মন্ত্রী>মন্ত্রিসভা, নারী>নারিবাচক, নদী>নদিমাতৃক।
১১. ৎ (উৎ) যুক্ত শব্দে ব-ফলা বসে না। যেমন: উচ্ছল, উচ্ছেদ, উচ্ছিন্ন, উজ্জীবন, কজ্জল, জগজ্জন, তজ্জন্য, বিপজ্জনক, সজ্জন।
১২. ৎ (উৎ) যুক্ত শব্দে ব-ফলা বসে। যেমন: উজ্জ্বল, উচ্ছ্বাস, উচ্ছ্বসিত, উদ্বর্ত, উদ্বর্তন, উদ্বাস্তু, উদ্বিগ্ন, উদ্বুদ্ধ, উদ্বুত্ত, উদ্বেগ, উদ্বেল, উদ্বোধক, উদ্বোধন, জগদ্বন্ধু, তদ্ব্যতীত, বিদ্যুদ্বগে, সদ্ব্যবহার।
১৩. অহম/ভয়ং/শুভম/সম/ম থাকলে ‘ঙ’ না বসে ‘ং’ বসে। যেমন: অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত, সংসার, অলংকার, সংকেত, সংক্ষেপ, সংকট, সংহার, সংরক্ষণ, সংলাপ, সংকল্প, সংকলন, সংকীর্ণ, শংকা, অহংকার, সংগঠন, সংঘাত, সংযোগ, সংবাদ, আড়ং, এবং, সং, ঠ্যাং, বরং, রং, সুতরাং, ঢং, শিং, স্বয়ং। ‘অ’ ধ্বনির পর ক খ গ ঘ ক্ষ থাকলে ‘ঙ্ক’ বসে। যেমন: অঙ্ক, অঙ্গ, অঙ্কন, আতঙ্ক, আকাঙ্ক্ষ, কঙ্কাল, অঙ্কুর, চিত্রাঙ্কন, জলাতঙ্ক, পালঙ্ক, পঙ্কজ, বঙ্গ, বিহঙ্গ, সঙ্গ, শঙ্কা, শঙ্খ, শৃঙ্খল, হিমাঙ্ক।
১৪. বিসর্গ বর্জিত শব্দ। যেমন: অন্তরঙ্গ, অন্তরীণ, অন্তরাল, নিসর্গ, নিষেধ, নিসৃত, প্রাতরাশ, বক্ষ্যমাণ, বয়োবৃদ্ধ, মনস্তত্ত্ব, মনোদুঃখ, মনোবিজ্ঞান, অন্তত, অংশত, অধ, অহ, অহরহ, আয়ু, ইতস্তত, ক্রমশ, তপ, প্রথমত, নভ, পয়, প্রায়শ, বস্তুত, মন,  অন্তস্থ, নিস্পন্দ, নিস্কব্ধ, নিস্পৃহা, নিশ্বাস, দুস্থ, মনস্থ, বক্ষস্থল।
১৫. বিসর্গ আশ্রিত শব্দ। যেমন: অন্তঃকরণ, অন্তঃপুর, অন্তঃসার, নিঃশেষ, নিঃসৃত, প্রাতঃকাল, বক্ষস্থল, বয়ঃক্রম, বয়ঃসন্ধি, মনঃক্ষুণ্ণ, মনঃসংযোগ, স্বতঃসিদ্ধ, অতঃপর, অধঃপতন, অন্তঃশীল, অন্তঃসার, চক্ষুঃশূল, দুঃশাসন, দুঃসংবাদ, দুঃসময়, দুঃসহ, দুঃসাধ্য, দুঃসাহসিক, দুঃস্থ, দুঃস্বপ্ন, নিঃশক্তি, নিঃশত্রু, নিঃশব্দ, নিঃশর্ত, নিঃশেষ, নিঃশ্বসন, নিঃশ্বাস, নিঃসংকোচ, নিঃসংশয়, নিঃসঙ্গ, নিঃসত্ত্ব, নিঃসন্তান, নিঃসন্দেহ, নিঃসম্বল, নিঃসরণ, নিঃসহায়, নিঃসাড়, নিঃসারণ, নিঃসৃত, নিঃস্নেহ, নিঃস্পৃহ, নিঃস্ব, নিঃস্বত, নিঃস্বার্থ, পয়ঃপ্রণালী, পুনঃপুন, পুনঃপ্রবেশ, পৌনঃপুনিক, প্রাতঃক্রিয়া, বয়ঃকনিষ্ঠ, বয়ঃপ্রাপ্ত, বহিঃপ্রকাশ, মনঃকষ্ট, মনঃপূত, মনঃস্থ, সদ্যঃপ্রসূত, স্বঃপ্রমাণিত, স্বঃতস্ফূর্ত।
১৬. নাসিক্যজাত শব্দে চন্দ্রবিন্দু বসে। যেসব সংস্কৃত শব্দে ন/ণ/চ/ম/ং বর্ণ থাকে সেসব বর্ণ উঠে চন্দ্রবিন্দু বসে। যেমন: অঙ্কন>আঁকা, অংশু>আঁশ, বংশি>বাঁশ, কঙ্ক>কাঁক/কাঁখ, কঙ্কণ>কাঁকন, বংশ>বাঁশ, হংস>হাঁস, অন্ধকার>আঁধার, স্কন্ধ>কাঁধ, বন্ধন>বাঁধা, খুন্টি>খুঁটি, কণ্টক>কাঁটা, কণ্টকি>কাঁঠাল, চন্দ্র>চাঁদ, কাঞ্চা>কাঁচা, ক্ষত>খুঁত/খুঁৎ, ক্ষোড>খুঁটি, সূচ>সুঁই, উচ্চ>উঁচু, উচ্ছিষ্ট>এঁটো, পঞ্চ>পাঁচ, ক্রন্দন>কাঁদা, ইন্দুর>ইঁদুর, সিন্দুর>সিঁদুর, স্কন্ধ>কাঁধ, বন্ধন>বাঁধন, সন্ধ্যা>সাঁঝ, কন্থা>কাঁথা, দন্ত্য>দাঁত, কম্পন>কাঁপা, পিপিলিকা>পিঁপড়া।
দেশিশব্দে চন্দ্রবিন্দু : ঝাঁটা, ডাঁস, ঢেঁকি, যাঁতা।
বিদেশিশব্দে চন্দ্রবিন্দু :
আরবি : তাঁবু, তুঁত, হুঁকা।
ফারসি : জাঁহাপনা, পিঁয়াজ, ফাঁদ, ফাঁশ, বাঁদি, হুঁশ, হুঁশিয়ার।
তুর্কি  : কাঁচি, বোঁচকা।
ফরাসি : আঁতাত, দাঁতাত, রেনেসাঁ।
পর্তুগিজ : পেঁপে।
হিন্দি  : কাঁচা, খাঁচা, গাঁজা, ঝাঁক, ঝুঁকি, টুঁটি, বাঁদি, ভোঁতা।
ইংরেজি : কৌঁসুলি, জাঁদরেল, রেস্তরাঁ।
১৭. ণ/ন-এর বানান /ণত্ববিধান
বাংলা তৎসম শব্দের ‘ণ’ বর্ণের সঠিক ব্যবহার বিধিকে ণত্ববিধান বলে। অথবা বাংলা শব্দে ‘ণ’ ও ‘ন’ বর্ণের সঠিক ব্যবহার বিধিকে ণত্ববিধান বলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতে, ‘শুধু সংস্কৃত শব্দে যেখানে ণ আছে, বাংলা ভাষায় ব্যবহারের সময় সেখানে তাই রাখতে হবে। এটাই ণত্ববিধান।’ কথা তৈরি করতে বর্ণ, শব্দ ও বাক্য লাগে কিন্তু অনেক সময় শব্দ ও বাক্যকে উপেক্ষা করে বর্ণ কথা বলে। যেমন:
নতুন অর্থে    : কিরে ন বউকে নিয়ে কেমন আছিস?
সংখ্যা অর্থে   : ন জন মানুষ এক পরিবারে।
নিষেধ/অভাব/নাসূচক : সে ন মানুষ ন জানোয়ার।
ণ বর্ণের বানান
১. সংস্কৃত শব্দে স্বভাবতই ‘ণ’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : গ্রহণ, স্বর্ণ, পণ্য, বীণা।
২. ঋ, ঋ-কারের পর ‘ণ’ বসে। যেমন : ঋণ, তৃণ।
৩. র, র-ফলা, রেফ-এর পর ‘ণ’ বসে। যেমন : চরণ, প্রাণ, কর্ণ।
৪. সাধারণত ষ-এর পর ‘ণ’ বসে। যেমন : ভাষণ।
৫. ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড) যুক্ত শব্দে ‘ণ’ বসে। যেমন : কণ্টক, কণ্ঠ, দণ্ড।
৬. নার, পার, পর-এর পর অয়ন যুক্ত শব্দে ‘ণ’ বসে। যেমন : নারায়ণ, রামায়ণ, পরায়ণ।
৭. প্র, পরি, নির উপসর্গ গঠিত শব্দে ‘ণ’ বসে। যেমন : প্রণাম, পরিত্রাণ, নির্ণয়, পরিণতি।
৮. অপর, প্র, পর, পূর্ব এ ওপর হ-এর সঙ্গে ‘ণ’ যুক্ত হয়। যেমন : অপরাহ্ণ, পরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ।
ন বর্ণের বানান
১৮. নাবাচক ক্রিয়া বিশেষণ ও উপসর্গ: নাই, নয়, না, নে, নি ন>নঞ> নাইং> নাই>নাই>না>নি>নে। ক্রিয়াবিশেষণ বা না বাচক শব্দ -নাই, নাই, নহে, নয়, না, আলাদা বসে। আর নে, নি ক্রিয়ার সঙ্গে বসে। দেখি নাই, দেখি না, দেখিনে, দেখিনি। এরা সাধারণ বর্তমান বা সাধারণ হিসাবেও বসে। নি দিয়ে অতীতকাল বোঝায়। নি বা না নাবাচক উপসর্গ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন: নিকৃষ্ট, নির্দয়, নিবাস, নিখাত, নিখুঁত, নিখোঁজ, নিমগ্ন, নিপুণ, নিবিড়, নিস্তব্ধ, নিপাতন, নির্বোধ, নির্লজ্জ, নিপাত, নারাজ, নাচার, নাখোশ, নালায়েক, নাপাক, নাবালক ইত্যাদি।
ন-এর সঠিক ব্যবহার -
১. তদ্ভব শব্দে ‘ন’ ব্যবহৃত হয়। যেমন: সোনা, কান, পান, নুন, ঘেন্না।
২. ত-বর্গীয় (ত, থ দ, ধ, ন) শব্দে ‘ন’ বসে। যেমন: অন্ত , অন্ন, অন্ধ, ছন্দ, পন্থা।
৩. ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড) বাদে অন্যান্য যুক্তবর্ণে ‘ন’ বসে। যেমন: অগ্নি, জন্ম, রতœ, স্নেহ, প্রশ্ন।
৪. ক্রিয়াপদে সব সময় ‘ন’ বসে। যেমন: খান, করেন, মরেন, পাঠান।
৫. বিদেশি শব্দে ‘ন’ বসে। যেমন: গ্রিন, ইস্টার্ন, কেরানি, হর্ন, কুরআন।
৬. সাধিত শব্দে ‘ন’ বসে। যেমন: সর্বনাম, নির্গমন, নিস্পন্ন, অহর্নিশ।
৭. শব্দের শুরুতে ‘ন’ বসে (ণত্ব, ণিজন্ত বাদে)। যেমন: নয়ন, নায়ক, নাক।
৮. ‘ণ’ বর্ণের পর ‘ন’ বসে। যেমন: গণনা, বর্ণনা, পাণিনি।
৯. সময়ে ‘ন’ বসে। যেমন : মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন।
১৯. ষ/স/শ-এর বানান /ষত্ববিধান
শ/স/ষ-এর সঠিক ব্যবহারকে ষত্ববিধান বলে। যেমন:
১. ঋ/ঋ-কারের পর সংস্কৃত শব্দে ‘ষ’ বসে। যেমন: ঋষভ, ঋষি, কৃষি, কৃষক, বৃষ্টি, তৃষ্ণা।
২. রেফ-এর পর ‘ষ’ বসে। যেমন: কর্ষ, বর্ষ, হর্ষ, বার্ষিক। নিষ্পাপ, নিষ্ফল, নিষ্পন্ন, নিষ্কৃতি।
৩. ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড) সংস্কৃত শব্দে ‘ষ’ বসে। যেমন: অষ্ট, কষ্ট, ষষ্ঠ, রুষ্ট, সৃষ্টি।
৪. অধি/অনু/অভি/ পরি/প্রতি/বি/সু যুক্ত উপসর্গে ‘ষ’ বসে। যেমন: অনুষঙ্গ, পরিষদ, পরিষ্কার, প্রতিষেধক, প্রতিষ্ঠান, বিষণ্ন, সুষম।
৫. ‘নিঃ’ ও ‘দুঃ’ উপসর্গে গঠিত শব্দে ‘ষ’ বসে অর্থাৎ নিষ ও দুষ যুক্ত শব্দে ‘ষ’ বসে। যেমন: নিষেধ, নিষ্পন্ন, দুষ্প্রাপ্য, দুষ্কর, দুষ্কৃতি।
৬. বিশেষ্য হলে ‘শ’ আর বিশেষণ হলে ‘ষ’ বসে। যেমন: আদেশ-আদিষ্ট, আবেশ-আবিষ্ট, ক্লেশ-ক্লিষ্ট, নির্দেশ-নির্দিষ্ট, প্রবেশ-প্রবিষ্ট, বিনাশ -বিনষ্ট।
৭. সন্ধি বা বিসর্গ সন্ধিতে ‘স’ বসে। সাৎ প্রত্যয়যুক্ত শব্দে স বসে। যেমন: তিরস্কার, পুরস্কার, ভাস্কর, বৃহস্পতি, আকসাৎ।
৮. বিদেশি শব্দে ‘শ’ বা ‘স’ বসে। চ-বর্গীয় শব্দে ‘শ’ বসে। ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড)  বিদেশি শব্দে স বসে। যেমন: তামাশা, খুশি, মসজিদ, সালাম, আশ্চর্য, নিশ্চয়, পশ্চিম, আগস্ট, মাস্টার, স্টোর, পোস্টার, স্কুল।
৯. বিদেশি শব্দে ‘স/শ’ বসে (‘ছ/ষ’ বসে না) ঝ, s>স, স্ট /sh>শ। যেমন: আর্টিস্ট, টুরিস্ট, টেস্ট, টোস্ট, টেস্টি, ডাস্টবিন, মাস্টার, পোস্টার, ফাস্ট, ব্রেকফাস্ট, রেজিস্ট্রার, স্কুল, স্টল, স্টপ, স্টেশন, স্টুডিও পেস্ট, স্টোর, স্ট্রিট, স্টেডিয়াম, স্টিকার, সিলেবাস, হোস্টেল, স্টেশন, সেশন, শিপ, ব্রিটিশ, মেশিন, কমিশন।

0 comments:

Post a Comment