বাংলা উচ্চারণের নিয়ম
বাংলা উচ্চারণ
শব্দ উচ্চারণের লিখিতরূপ হলো বানান তবে শব্দের উচ্চারণ ও লিখিতরূপ এক নাও হতে পারে। যেমন: অণু (ওনু,) কবি (কোবি), বধূ (বোধু), স্বাগতম (শাগোতোম), পদ্ম (পদদো), আত্মা (আৎতা), সমাস (শমাশ) ইত্যাদি। তবে প্রায় নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমেই এমনটি হয়ে থাকে। বর্ণানুসারে যদি বানান করতে যাই তাহলে বানান বিপর্যয় হবে। যেমন: পদ্ম, পদ্মা, আৎমা ইত্যাদি। যার ঠোঁট, দাঁত, তালু, জিভ, নাক, কণ্ঠ, ফুসফুস স্বাভাবিক নয় সে শুদ্ধ উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হয় কিন্তু যার এগুলো স্বাভাবিক যে সফলভাবে উচ্চারণ করতে পারে। শব্দের উৎপত্তিগত কারণে শব্দের বানান ও উচ্চারণ এক নাও থাকতে পারে। শব্দ বানাতে প্রয়োজন হয় বর্ণ ও বর্ণচিহ্ন আর উচ্চারণে প্রয়োজন হয় ধ্বনি। ধ্বনি উচ্চারণে প্রয়োজন হয় বাগযন্ত্র। যাদের বাগযন্ত্র অর্থাৎ ঠোঁট, দাঁত, তালু, জিভ, নাক, কণ্ঠ, ফুসফুস স্বাভাবিক নয় তারাও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার বাগযন্ত্র স্বাভাবিক থাকলেও অনেকে শুদ্ধ উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ তারা উচ্চারণ সম্পর্কে সচেতন নয়। একজন বাঙালি যে দেশপ্রেমিক তার প্রথম ও প্রধান প্রমাণ সে বাংলা শব্দের অর্থ জানে প্রমিত বানান জানে এবং শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারে। তাই খাঁটি বাঙালি হতে হলে এসব ব্যর্থতা দূরে ঠেলে সফলতা অর্জন করতে হয়। আর সফলতা পেতে আজ আর প্রাণ দিতে হবে না। শুধু নিচের নিয়মগুলো সচেতনভাবে জেনে রাখতে হবে।
উচ্চারণযন্ত্র
প্রাণিজগত থেকে মানুষ তার মানবীয়গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আলাদা করে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পেরেছে তার মস্তিষ্কের কারণে। আর এই কাজে মস্তিষ্ককে সহযোগিতা করেছে তার নাম বাগযন্ত্র। বাগযন্ত্র ছাড়া মানুষ কথাই বলতে শিখতে পারত না। যে কথার নাম ভাষা। মানুষ থাকত ভাষাহীন। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ বইতে বাগযন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, মানবদেহের যেসব প্রত্যঙ্গ ধ্বনির উচ্চারণের সঙ্গে যুক্ত তাদের বাগযন্ত্র বা বাক্প্রত্যঙ্গ বলে। শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া আর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি এগুলোর সাহায্যে মানুষ কথাবার্তা বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করে। বাগযন্ত্র বলতে শরীরের উপরিভাগে অবস্থিত মধ্যচ্ছদা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত শ্বাসবাহী বিশেষ প্রত্যঙ্গকে বোঝায়। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য অঙ্গপ্রতঙ্গের সাহায্য নেয়। এই অঙ্গপ্রতঙ্গকে বাগযন্ত্র বলে। শরীরের যেসব অংশ ধ্বনি তৈরিতে সাহায্য করে তাদের বাগযন্ত্র বলে। বাগযন্ত্রগুলো হলো :
১. ঠোঁট/ওষ্ঠ্য
২. দন্ত্য/দাঁত—অগ্রদন্ত্য, পশ্চাৎদন্ত্য পাটি, দন্ত মূল
৩. তালু—অগ্রতালু/শক্ত তালু, পশ্চাৎতালু/নরম তালু
৪. নাক/নাসা, নাসিকা, নাসা-গহ্বর
৫. জিভ—আলজিভ, জিভ অগ্র, সম্মুখ জিভ, পশ্চাদজিভ , জিভমূল
৬. কণ্ঠ, স্বরপল্লব, স্বরতন্ত্রী
৭. ফুসফুস
বাগযন্ত্রগুলো সব সময় ব্যায়ামে রাখা দরকার। যেমন: ঠোঁট মুখের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যার আরেক নাম অধর। অধরের দুটি অংশ। উপরের ঠোঁট ও নিচের ঠোঁট। শব্দ উচ্চারণের জন্য ঠোঁট গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যদি কারো ঠোঁট একটু বেশি কেটে যায় অর্থাৎ ঠোঁট কেটে দাঁত বের হয়ে যায় তাহলে তার সব বর্ণে উচ্চারণ হবে নাসিক্য। যেমন : ‘আমি ভাত খাই’ হবে ‘আঁমিঁ ভাঁতঁ খাঁইঁ’। প্রত্যেটি বর্ণ স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঠোঁটের সাহায্যে উচ্চারিত হয়। কোথাও ঠোঁট বেশি ফাঁক করতে হয়, কোথাও ঠোঁট জোড়া লেগে আবার ফাঁক হয়ে যায়, কোথায়ও কম, কোথায়ও চেপে, গোল করে সামনের দিকে ঠেলে উচ্চারণ করতে হয়। যেমন: অ, আ, ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, দ, ধ, প, ফ, ব, ভ, ম, ল, শ ইত্যাদি বর্ণ উচ্চারণ করতে ঠোঁট দুটি অনেক ফাঁক করতে হয়। প, ফ, ব, ভ, ম-উচ্চারণ করতে ঠোঁট দুটি লাগিয়ে আবার জোরে ফাঁক করতে হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় থেকে উচ্চারণ করা গেলে সবচে ভাল হয়। জিভ শুধু রস আস্বাদন করে না ধ্বনি উচ্চারণে সাহায্য করে থাকে। দুটি জিভ আছে একটি নিচের চোয়ালের সঙ্গে বড় এবং চ্যাপ্টা আর অন্যটি ভেতরে ঘণ্টার মতো ঝুলন্ত। পান চিবোলে জিভ ভারি হয়। ভারি জিভ কখনো উচ্চারণে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারে না। সঠিক উচ্চারণের জন্য ধীরে পাঠ করা, জড়তা কাটানোর জন্য জিভ উল্টানো, উচ্চারণ সঠিক করার জন্য পাতলা কিছু দিয়ে জিভ আঁচড়িয়ে হালকা করে নেয়া জরুরি। মুখের যে অংশে দাঁত সংলগ্ন থাকে সেই চোয়াল। চোয়ালে জোর না থাকলে আবৃত্তি করা সম্ভব নয়। তাই চোয়ালের ব্যায়াম জরুরি। চোয়ালকে ডান-বাম করে ব্যায়াম করা যায়। তবে সবচে উপযুক্ত ব্যায়াম হলো চুইংগাম চিবানো।
বাংলা শব্দ উচ্চারণের সমস্যা
বাংলা ভাষার প্রমিত উচ্চারণের সমস্যা ৫টি। যেমন:
১. রূপের অমিল: বাংলা লিখিতরূপের সঙ্গে উচ্চারিতরূপ প্রায়শই মেলে না। যেমন: পদ্ম-পদ্দো, বিশ্ব-বিশশো।
২. সংখ্যাগত: বাংলা বর্ণমালার একাধিক বর্ণের উচ্চারণ একটি এবং কখনও কখনও একটি বর্ণের উচ্চারণ অধিক। যেমন: শ-ষ-স।
৩. প্রাণ ঘটিত: উচ্চারণকালে মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো প্রায়ই অল্পপ্রাণ ধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমন: তারিখ-তারিক।
৪. আঞ্চলিক গত: অঞ্চলভেদে এক অঞ্চলের শব্দের উচ্চারণ অন্য অঞ্চল থেকে পৃথক হয়। যেমন: কথা— কতা, প্রার্থনা— প্যারারথনা।
৫. বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা: এটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলা উচ্চারণ শেখার কোন ব্যবস্থা নাই।
উচ্চারণের নির্ভরশীলতা
উচ্চারণের ওপর অক্ষর নির্ভর করে। অনেকে বর্ণকে অক্ষর হিসেবে বিবেচনা করেন যা ঠিক নয়। শব্দের খণ্ডাংশকে অক্ষর বলে। শব্দের যতটুকু অংশ একবারে উচ্চারণ করা যায় ততটুকুই অক্ষর। অন্যভাবে বলা যায়, উচ্চারণ ঠিক রেখে বাংলা শব্দ যতটা ভাঙ্গা যায় ততটাই অক্ষর। অক্ষর হতে হলে স্বরবর্ণ লাগে। যেমন: বর্ণমালা=বর+নো+মা+লা। অক্ষর ২ প্রকার। যেমন:
ক) স্বরাক্ষর
যে অক্ষর স্বর দিয়ে টেনে পড়া যায় তাকে স্বরাক্ষর বলে। উচ্চারণকালে যদি কোন অক্ষর স্বরধ্বনি দিয়ে শেষ হয় অথবা অক্ষর টেনে টেনে পড়া যায় তাকে স্বরাক্ষর বলে। যেমন: আ-কা-শি, মাটি-মা+টি, বা+ড়ি। একই শব্দে স্বরাক্ষর বা হসাক্ষর থাকতে পারে। যেমন: বানান—বা+নান।
খ) হসাক্ষর
যে অক্ষর স্বর দিয়ে টেনে পড়া যায় না অর্থাৎ থেমে যেতে হয় তাকে হসাক্ষর বলে। উচ্চারণকালে যদি কোন অক্ষর স্বরধ্বনি দিয়ে শেষ না হয় অথবা অক্ষর টেনে টেনে পড়া যায় না যায় বা আটকে যায় তাকে হসাক্ষর বলে। যেমন: অক্ষ—অক+খর।
বর্ণভিত্তিক উচ্চারণ
স্বরবর্ণের উচ্চারণ
অ : স্বরে-অ = অজগর
আ : স্বরে-আ = আম
ই : হ্রস্ব-ই = ইলিশ
ঈ : দীর্ঘ-ঈ = ঈগল
উ : হ্রস্ব-উ = উট
ঊ : দীর্ঘ-উ = ঊষা
এ : = একতারা
ঐ : ও+ই = ঐরাবত
ও : = ওজন, রম
ঔ : ও+উ = ঔষুধ
বর্ণগুলো বর্ণমালায় উচ্চারিত হয় একরকম আর ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যোগ হলে উচ্চারিত হয় ভিন্ন রকম।
স্বরের পর্যায়গত উচ্চারণ
বর্ণ
|
অশুদ্ধ উচ্চারণ
|
বর্ণমালায় শুদ্ধ উচ্চারণ
|
শব্দে শুদ্ধ উচ্চারণ
|
অ
|
অ
|
স্বরে অ
|
স্বরে অ জঅ — অজ
|
আ
|
আ
|
স্বরে আ
|
স্বরে আ মঅ — আম্
|
ই
|
ই /রোশ্শি/হশ্শোই
|
রোশ্য-ই
|
রোশ্য-ই টঅ — ইট্
|
ঈ
|
ঈ /দির্ঘি
|
দীর্ঘ-ঈ
|
দীর্ঘ-ঈ দঅ — ঈদ্
|
উ
|
উ /রোশ্শু/হশ্শোউ
|
রোশ্য-উ
|
রোশ্য-উ টঅ — উট্
|
ঊ
|
ঊ /দুর্গূ
|
দীর্ঘ-ঊ
|
দীর্ঘ-ঊ নঅ — ঊন
|
জিভের অবস্থান অনুসারে উচ্চারণ
জিভের অবস্থান
উচ্চ
উচ্চমধ্য
নিম্ন
নিম্নমধ্য
|
সম্মুখভাগ
ই
এ
এ্যা
আ
|
মধ্যভাগ
উ
ও
অ
|
ঠোঁট গোলাকৃতি ফাঁকে উচ্চারিত হয় = অ, উ, র
ঠোঁট গোলাকৃতি ফাঁকে দীর্ঘ উচ্চারিত হয় = ঊ, ঔ
ঠোঁট প্রসারিত ফাঁকে উচ্চারিত হয় = ই, এ, আ, অ্যা/এ্যা
ঠোঁট প্রসারিত ফাঁকে দীর্ঘ উচ্চারিত হয় = ঈ, ঐ
|
ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ
স্বল্পপ্রাণ বর্ণ হলে ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে ‘অ’ আর মহাপ্রাণ বর্ণ হলে ‘অ+হ’ উচ্চারণ করতে হয়। হসোচ্চারণে হসচিহ্ন ( ্ ) বসে। যেমন:
ক : কঅ = কল্
খ : খঅ+হ = খই
গ : গঅ = গম্
ঘ : ঘঅ+হ = ঘর্
ঙ : উঙঅ = বাঙালি
চ : চঅ = চক্
ছ : ছঅ+হ = ছই
জ : জঅ = জগ্
ঝ : ঝঅ+হ = ঝড়্
ঞ : নিঅ/নঅ = সঞ্চয়/সন্চয়
ট : টঅ = টক্
ঠ : ঠঅ+হ = ঠক্
ড : ডঅ = ডাক্
ঢ : ঢঅ+হ = ঢাকা
ণ : মূর্ধ্যনে = ণই
ত : তঅ = তল
থ : থঅ+হ = থই
দ : দঅ = দই
ধ : ধঅ+হ = ধন
ন : দন্ত ন্য = নয়
প : পঅ = পণ্
ফ : ফঅ+হ = ফল্
ব : বঅ = বল্
ভ : ভঅ+হ = ভর্
ম : মঅ = মই
য : অন্তঃস্থ যঅ = যম্
র : ব-এ শূন্য রঅ = রব্
ঋ : রৃ = ঋণ্
ল : লঅ = লজ্জা
শ : তালব্য-শঅ = শশা
ষ : মূর্ধ্যন-শঅ = ষড়
স : দন্ত -স = স্রোত্
হ : হঅ+হ = হংস
ড় : ড-এ শূন্য ড়অ = আড়ৎ
ঢ় : ঢঅ+হ-এ শূন্য ঢ়অ = আষাঢ়্
য় : অন্তঃস্ত য়অ = হয়
আশ্রিতবর্ণ
বিসর্গ = দুঃখ্
চন্দ্রবিন্দু = চাঁদ্
হসবর্ণ
খণ্ডউঙঅ /অনুস্বার = রং
খণ্ড-তঅ = সৎ
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের স্থানগত উচ্চারণ
কোন বর্ণ বাগযন্ত্রের কোন স্থানের সাহায্যে উচ্চারিত হয় তা দেয়া হলো:
স্বরবর্ণ
|
ব্যঞ্জনবর্ণ
|
নাম
|
উচ্চারণ স্থান
|
অ আ
|
ক খ গ ঘ ঙ /হ
|
কণ্ঠধ্বনি
|
কণ্ঠ +জিভমূল
|
ই ঈ
|
চ ছ জ ঝ ঞ/য য় শ
|
তালব্যধ্বনি
|
তালু +জিভমধ্য
|
ট ঠ ড ঢ ণ /র ঋ ষ
|
মূর্ধন্যধ্বনি
|
মূর্ধা +উল্টানো জিভ
| |
ত থ দ ধ ন /ল স
|
দন্ত ধ্বনি
|
দন্ত +জিভ অগ্র
| |
উ ঊ
|
প ফ ব ভ ম
|
ওষ্ঠধ্বনি
|
ওষ্ঠ +ঠোঁট
|
এ ঐ
|
কণ্ঠতালব্যধ্বনি
|
কণ্ঠ +তালু
| |
ও ঔ
|
ট ঠ ঢ ণ /র ঋ ষ
|
কণ্ঠোষ্ঠধ্বনি
|
কণ্ঠ +ওষ্ঠ
|
অন্তঃস্থ ব
|
দন্তোষ্ঠধ্বনি
|
দন্ত +ওষ্ঠ
| |
ঙ ঞ ণ ন ম ং ঁ
|
নাসিক্যধ্বনি
|
নাসিক্য
|
উচ্চারণের প্রকরণ
যেসব ধ্বনি টেনেটেনে উচ্চারণ করা যায় তাদের স্বরধ্বনি বলে। অথবা যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের কোন জায়গায় বাধা না পেয়ে উচ্চারিত হয় তাদের স্বরধ্বনি বলে। স্বরধ্বনির লিখিতরূপকে স্বরবর্ণ বলে। সংস্কৃতে স্বরধ্বনির উচ্চারণ আলাদা হলেও বাংলাতে নয়। কোন কোন বর্ণের উচ্চারণ একরকম হলেও এদের ব্যবহার কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। ১০টি স্বরবর্ণ হলেও (অ আ, ই ঈ, উ ঊ, এ ঐ, ও ঔ) উচ্চারণের দিক দিয়ে স্বরধ্বনি সর্বমেটি ৭টি (অ, আ, ই, উ, এ, এ্যা/অ্যা, ও)। আর দীর্ঘ উচ্চারণের দিক দিয়ে স্বরধ্বনি ২টি (ঐ-ও+ই/ঔ-ও+উ)। সাধারণত প্রায় সব বর্ণের উচ্চারণ দুইভাবে হয়। যেমন:
ক) বিবৃত উচ্চারণ : অ-ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণকে বিবৃত উচ্চারণ বলে। যেমন : অমর, অনাচার, কলম, তৃণ, গঠিত, অক্ষম, বাকপটু, ঢোলক, বাগধারা ইত্যাদি।
খ) সংবৃত উচ্চারণ : অ-ধ্বনি উচ্চারণ ‘ও’-এর মতো হলে তাকে সংবৃত উচ্চারণ বলে। অন্যভাবে বলা যায়, অ-ধ্বনি উচ্চারণকালে ঠোঁট গোলাকৃত হয় বলে একে সংবৃত উচ্চারণ বলে। যেমন: অধীন/ওধিন, মন/মোন, স্রষ্টা/স্রোশটা, শ্রাবণ/স্রাবোন ইত্যাদি।
উচ্চারণের নিয়ম
শব্দ যদি অক্ষরে (স্বরাক্ষর ও হসাক্ষর) ভাগ করে উচ্চারণ করা হয় তাহলে উচ্চারণ ও বানান দুটিই সহজ হয়ে যায়। যেমন: সুন্দর— সুন+দোর। এখানে দোর হবে কারণ যুক্তবর্ণ বিশ্লেষণ করলে পরের বর্ণের সঙ্গে ও-কার যুক্ত হয়। বানানো শব্দের উচ্চারণ কিন্তু অনেক সময় শব্দের ওপর নির্ভর করে না। আবার এমন কিছু সংস্কৃত শব্দ আছে যার লিখিত রূপ আর উচ্চারিত রূপ এক নয়। লেখি ‘অণু’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘ওনু’। লেখি ‘স্বাধীন’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘শাধিন’ আর সংস্কৃতে উচ্চারিত হয় ‘সুয়াধিন’ লেখি ‘নদী’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘নোদি’। লেখি ‘সহ্য’ আর উচ্চারণ করি ‘সোজঝো’। লেখি ‘সমাস’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘শমাশ’। লেখি ‘শ্রমিক’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘স্রোমিক’। কেনো এমন হয়, এসব জানতেই আমাদের উচ্চারণের নিয়ম শিখতে হয়।
শুদ্ধ শব্দ উচ্চারিত হয় শুদ্ধ বর্ণ উচ্চারণের মাধ্যমে। আগে শিখতে হয় বর্ণগুলোর সঠিক উচ্চারণ তা ওপর শিখতে হয় শব্দের উচ্চারণ। অবশ্যই মনে রাখতে হয়, বর্ণমালায় অবস্থানরত বর্ণ ও শব্দে অবস্থানরত বর্ণের উচ্চারণ এক রকম নয়। বর্ণ শব্দে স্থান নেয় স্বরচিহ্ন ও ব্যঞ্জনচিহ্ন যোগে। তাই বর্ণের নিজস্ব উচ্চারণ থাকে না। যেমন: কলম-কলোম, কবি-কোবি, সমাজ-শমাজ, শ্রমিক-স্রোমিক। আবার সংস্কৃত শব্দের বাংলা বানান গ্রহণ করলেও উচ্চারণ গ্রহণ করে না। যেমন: স্বাগতম (বাংলা)-সোয়াগাতম (সংস্কৃত)। আবার বিদেশি শব্দ বাংলায় অবস্থান করলেও তাদের বানান ও উচ্চারণ বাংলা বানান গ্রহণ করে না। যেমন: চকোলেট-চকলেট, হসপিটাল-হাসপাতাল, রাসূল-রসুল, নূন/Noon-নুন। তবে উচ্চারণের জন্য কিছু নিয়ম অনুসরণ করা দরকার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ/ও-এর উচ্চারণ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন :
১. শব্দের প্রথমে ‘অ’ দিয়ে গঠিত শব্দটি যদি নাবোধক হয় তাহলে অ-এর উচ্চারণ হবে ‘অ’ এর মতো। যেমন: অমর, অটল, অনাচার, অপকারী, অকথা, অকাজ, অবোধ ইত্যাদি।
২. শব্দের প্রথমে ‘অ’ দিয়ে গঠিত শব্দটি যদি নাবোধক না হয় যদি অন্য অর্থবোধক শব্দ হয় তাহলে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: অমর (ওমর,নাম), অধীন (ওধীন), মন (মোন) ইত্যাদি।
৩. শব্দের প্রথমে ‘অ’ এবং এর পরে যদি ‘আ’ থাকে তাহলে অ-এর উচ্চারণ হবে ‘অ’ এর মতো। যেমন: অনাচার, অমানিশা, কথা।
৪. সম্বোধনসূচক শব্দ ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন : ও/অ ভাই, ও/অ কপাল।
৫. বিদেশি শব্দে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: অক্ত-ওক্ত, অজু-ওজু।
৬. ‘এ’ কখনো ‘এ’ আবার কখনো ‘এ্যা’ উচ্চারিত হয়। যেমন: ‘এ’ : দেশ, বেশ, এসো, এলো। ‘এ্যা’ : দেখা, বেচা, ফেলা, হেলা, ঠেলা ইত্যাদি। কিন্তু এ-কারের পরে যদি ই/উ/এ/ও-কার থাকলে ‘এ’ উচ্চারিত হয়। যেমন: একি, দেখি, বেশি, মেঠো।
৭. ‘এক’ শব্দ ‘এ্যা’ উচ্চারিত হয়। যেমন: এক। আবার তিন বর্ণ বিশিষ্ট শব্দে ‘এ’ উচ্চারিত হয়। যেমন : একাল, একতা, একান্ত, যেমন, এমন, কেমন, মেলা, এসিড।
৮. দৃশ্যগত ‘অ্যা’ উচ্চারিত শব্দ। যেমন : ব্যাং, ব্যাঙ, খ্যাপা, ব্যাখ্যা।
৯. ‘এ্য’ থাকলেও ‘এ’ উচ্চারিত হয়। যেমন: ব্যক্তি (বেক্তি), ব্যতিক্রম (বেতিক্রম), ব্যতিহার, ব্যতীত, ব্যভিচার।
১০. ‘এ্যা’ উচ্চারিত হবে না। যেমন: এবং, একুশ, এমনি।
১১. দ্বিস্বর বা যৌগিকবর্ণ ‘ওই’ উচ্চারিত হয়। যেমন : ঐক্য (ওইককো), ঐতিহ্য (ওইতিজঝো), কৈ (কোই), দৈ (দোই) ইত্যাদি।
১২. অনেক সকয় ‘ঐ’ ভেঙে ‘ওই’ উচ্চারিত হয়। যেমন : ওইখানে যাও।
১৩. ই/ঈ/এ-যুক্ত বর্ণের পরের বর্ণে যদি ‘য়’ থাকে তাহলে ‘অ’ সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: প্রিয়, স্বীয়, দেয়, স্মরণীয়, বরণীয়, তুলনীয়। কিন্তু স্বরকার যুক্ত থাকলে ‘অয়’ উচ্চারিত হয়। যেমন: খায়, বায়, নায়, পায়, মায়, গায়, যায়।
১৪. প্রথম বর্ণের সাথে ঋ, ঐ, ঔ যুক্ত হলে পরের ‘অ’ প্রায়ই ‘অ’ এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: তৃণ, ধৈর্য, মৌন ইত্যাদি।
১৫. হসচিহ্ন নাই তবে হসোচ্চারিত হয়। যেমন : মত, জল, কল, মল, ঢল, চল, হল।
১৬. ‘বাক’ ও ‘বাগ’ যুক্ত শব্দের ‘ক’ সব সময় ‘ক্’ উচ্চারিত হয়। যেমন : বাকচাতুর্য, বাকপটু, বাকশক্তি, বাকসংযম, বাকশক্তি, বাকশুদ্ধি, দিকপতি, দিকপাল ইত্যাদি।
১৭. বাগ ও দিগ যুক্ত শব্দের ‘গ’ সব সময় ‘গ্’ উচ্চারিত হয়। যেমন: বাগদান, বাগধারা, বাগবিতণ্ডা, বাগবিধি, বাগবিন্যাস, বাগবৈদগ্ধ, বাগযুদ্ধ, দিগজ্ঞান, দিগদর্শন, দিগভ্রান্ত ইত্যাদি।
১৮. ই/ঈ/উ/ঊ-কারের আগের ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: কবি (কোবি), নদী (নোদি), মরু (মোরু), বধূ (বোধু), জননী (জনোনি), উপকূল (উপোকুল), অণু (ওনু), গরু (গোরু), কদু/কোদু, ছোট (ছোটো), প্রিয় (প্রিয়ো), যাবতীয় (যাবতিয়ো)।
১৯. তিন বর্ণবিশিষ্ট্য শব্দের মাঝের বর্ণ ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: কলম (কলোম), কলস, জীবন, মরণ, ধরন, গঠন, চরণ, স্মরণ।
২০. স্বরসঙ্গতির কারণে শব্দের মধ্যে ও শেষে ধ্বনিটির উচ্চারণ হবে ‘অ’ এর মতো। যেমন: কলম, যত, শ্রেয়।
২১. তম, তর, তন শব্দে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন : প্রিয়তম (প্রিয়তমো), গুরুতর (গুরুতরো,) বৃহত্তর (বৃহোৎতরো), সর্বোত্তম (শরবোৎতোমো) ইত্যাদি।
২২. সাধারণত ক্রিয়াপদে ‘ও’ বসে না। তবে পক্ষ ও অর্থ পরিষ্কার করতে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: পড়-পড়ো-পড়ান-পড়ানো, সে পড়ে (পোড়ে) চলে (চোলে) গেলো (গেলো)।
২৩. সাধুক্রিয়া থেকে চলিত ক্রিয়ারূপে ‘ও’ উচ্চারিত হয়। ছ, ল, ব, ত যুক্ত ক্রিয়াপদের ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: বলছ (বোলছো), বলল (বোললো), বলব (বোলবো), করত (কোরতো)।
২৪. সাধু ক্রিয়া থেকে চলিত ক্রিয়ায় রূপান্তরিত করতে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : করিবার>করবার (কোরবার), ধরবার (ধোরবার), মরবার (মোরবার), চড়বার (চোড়বার) ইত্যাদি।
২৫. সমাপিকা ক্রিয়ায় ব্যবহৃত ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: সে কাজটি করে। করে সমাপিকা তাই ‘ও’ উচ্চারিত হবে না। সে কাজটি করে চলে যাবে। এখানে কোরে ও চোলে উচ্চারিত হবে।
২৬. দ্বন্দ্বযুক্ত বানানে অথবা আদেশ ও অনুরাধ জাতীয় ক্রিয়ায় ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চাতি হয়। যেমন: হল-হলো, এল-এলো, সব-সবো, বল-বলো, চল-চলো, মল-মলো, বসে-বোসে, বলে-বোলে, ফোঁটে-ফুটে, ওঠে-উঠে, হলে-হোলে, করে-কোরে, লব-লবো ইত্যাদি।
২৭. কিছু বিশেষ্য ও বিশেষণের পার্থক্য দূর করতে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: কাল-কালো, ভাল-ভালো, খাট-খাটো।
২৮. জ্ঞ (জ+ঞ) প্রথম থাকলে গ্যাঁ আর অন্য স্থলে থাকলে গঁগ, গঁগো উচ্চারিত হয়। যেমন: জ্ঞান (গ্যাঁন), অজ্ঞান (অগঁগান), অজ্ঞ (অগঁগো), জিজ্ঞাস (জিগঁগাস)।
২৯. পক্ষ ও কালের কারণে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: পড়-পড়ো, ধর-ধরো, বল-বলো, সাজ-সাজো, বাধ-বাধো, হার-হারো, মার-মারো, বক-বকো, কর-করো। অনুজ্ঞায় ‘অ’ ধ্বনি ‘ও’ উচ্চারিত না হয়ে প্রযোজক ক্রিয়ায় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: লাগান-লাগানো, জাগান-জাগনো, ভুলান-ভুলানো ঢাল-ঢালো, উঠান-উঠানো, বসান-বসানো, করান-কারানো, তাড়ান-তাড়ানো, বলান-বলানো, শেখান-শেখানো, লেখান-লেখানো, চালান-চালানো ইত্যাদি।
৩০. ব্যঞ্জনে যুক্ত ‘ঔ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও+উ’ উচ্চারিত হয় এবং শেষে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন : গৌণ/গোউনো, মৌন/মোউনো, পৌর, যৌথ, ধৌত, ভৌম, সৌধ।
৩১. বিসর্গ ‘ঃ’ ‘খ’-এর পরে থাকলে ক্+খ উচ্চারিত হয়। যেমন : দুঃখ (দুক্খো)।
৩২. বিসর্গ ‘ঃ’ যে বর্ণের আগে থাকে সেই বর্ণকে দ্বিত্ব উচ্চারণ করতে হয়। যেমন: অতঃপর (অতপপর), নিঃশেষ (নিশশেশ), দুঃসময়, দুঃসাহস, অন্তঃসার ইত্যাদি।
৩৩. সন্ধিজাত শব্দের বানানে ‘অ/ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন : সজ্জন (সজজোন), নিরন্ন (নিরন্নো), শয়ন (শয়োন), দুরন্ত (দুরোন্তো)।
৩৪. সমাসবদ্ধ শব্দের মাঝে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: পথচারী (পথোচারী), হিতকর, বোধগম্য, জনগণ (জনোগণ), ক্ষণসময়, বনবাসী, ধনপতি। কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন : রাজপুত্র (রাজপুতত্রো), মেঘদূত, মেঘনাদ।
৩৫. উপসর্গজাত নাবোধক শব্দে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘অ’ উচ্চারিত হয়। যেমন : অকাল, অদৃশ্য।
৩৬. তদ্ধিত প্রত্যয়জাত শব্দের মাঝে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় (অক) ‘অ’ উচ্চারিত হয়। যেমন: ঢোলক, মড়ক, টনক, বৈঠক ইত্যাদি।
৩৭. এমন কিছু তিন বর্ণযুক্ত শব্দে মাঝের বর্ণে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: যতন (যতোন), কলস, কলম, কাজল, পাগল, আদর, ছোবল ইত্যাদি। আবার এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন : অমর, অনড়, অটল, অচল, অজয়, সরস, সবল, সজল।
৩৮. রেফযুক্ত বর্ণে আগের ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: পর্যন্ত (পোর্যোনতো), পর্যায় (পোর্যায়), চর্যাপদ, ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য, আশ্চর্য, সূর্য, কার্য, কর্ম, ধর্ম, গাম্ভীর্য, কর্তব্য, কর্তৃপক্ষ, প্রবর্তন, মর্যাদা। আবার এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন: গর্জন, বর্জন।
৩৯. য-ফলাযুক্ত বর্ণ কখনো উচ্চারিত হয় না আবার কখনো উচ্চারিত হয় আবার কখনো দ্বিত্ব হয়। যেমন:
ক) অনুচ্চারিত : জ্যোতি, জ্যৈষ্ঠ।
খ) এ্যা উচ্চারণ : ব্যয়, ত্যাগ, ব্যাগ।
গ) দ্বিত্ব উচ্চারণ : পদ্য (পোদদো), জন্য (জোননো), শস্য (শোশশো)।
৪০. ক্ষ-যুক্ত শব্দে আগের বর্ণ ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: অক্ষ (ওকখো), বক্ষ (বোকখো), লক্ষ (লোকখো, রক্ষা (রোকখা), পক্ষ (পোকখো)।
৪১. য-ফলাযুক্ত শব্দে আগের বর্ণ ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: অন্য (ওননো), অন্যতম (ওননোতমো), গদ্য (গোদদো), পদ্য (পোদদো), কথ্য (কোতথো), সত্য (শোৎতো), কন্যা (কোননা), বন্যা (বোননা), কল্যাণ (কোললান), শয্যা (শোজজা), সহ্য (শোজঝো), কাব্য (কাববো), বন্য (বননো), পণ্য (পোননো), জন্য (জোননো), শস্য শোসসো), মধ্য (মোদধো), তথ্য (তোতথো)।
৪২. বিশেষণ থেকে বিশেষ্য শব্দে য-ফলাযুক্ত শব্দে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’+দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন: দীন-দৈন্য (দোইননো), বিচিত্র-বৈচিত্র্য (বোইচিৎত্রো), বিশিষ্ট-বৈশিষ্ট্য (বোইশিশটো)।
৪৩. ‘সম’ উপসর্গযুক্ত ‘স’ হয় তাহলে ‘স’ সব সময় ‘অ’ উচ্চারিত হয়। যেমন: সমিতি, সমুদয়, সমুদ্র, সম্পূর্ণ, সমৃদ্ধি, সংখ্যা।
৪৪. ‘স’ যদি সহিত অর্থে ব্যবহৃত হয় তাহলে ধ্বনিটির উচ্চারণ হবে ‘অ’ এর মতো। যেমন: সঠিক, সচিত্র, সবিনয়, সজীব, সক্ষম।
৪৫. যুক্তবর্ণের শেষ বর্ণে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: মন্দ (মোনদো), উত্তর (উৎতোর), মুগ্ধ, আমসত্ত্ব, সুন্দর, সৌন্দর্য, বিচক্ষণ, স্পষ্ট, স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্ন, উপযুক্ত, রক্ষা, যন্ত্র, সপ্তম, ভুক্ত, সূর্য, আন্ত, স্তম্ভ, রঞ্জক, শক্তি, বিশিষ্ট্য, চিহ্ন, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, সিদ্ধান্ত, ছাত্র, অল্প, ব্যক্ত, কাব্যগ্রন্থ, পক্ক ইত্যাদি।
৪৬. ঐ, ঔ, ং, ঃ, ঋ যুক্ত বর্ণের পরের বর্ণ ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: তৈল, বৈধ, সৌর, যৌথ, সৌধ, দুঃখ, তৃণ, ঘৃণ ইত্যাদি।
৪৭. ১১ থেকে ১৮ পর্যন্ত সংখ্যাবাচক শব্দের শেষবর্ণে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: এগার (এগারো), বার (বারো), চৌদ্দ (চৌদদো), পনের (পোনেরো), ষোল (শোলো), সতের (শোতেরো), আঠার (আঠারো) ইত্যাদি। বর্তমানে এসব শব্দ ‘ও’ দিয়ে লেখা হচ্ছে।
৪৮. র-ফলা থাকলে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: স্রষ্টা (স্রোশটা), শ্রবণ (স্রোবোন), প্রচুর, প্রতীক, প্রস্তাব ইত্যাদি।
৪৯. অনেক সময় বিসর্গযুক্ত র্বণ আবেগ জাতীয় ধ্বনি হ-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: আঃ (আহ), উঃ (উহ), ওঃ (ওহ) ইত্যাদি।
৫০. শব্দের শেষে হ বা ঢ় থাকলে ‘অ’ ধ্বনি সব সময় ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: দেহ (দেহো), বিবাহ (বিবাহো), কলহ (কলোহো), স্নেহ (স্নেহো), গূঢ় (গুঢ়ো), গাঢ় (গাঢ়ো), দৃঢ় (দৃঢ়ো) ইত্যাদি। তবে ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন : আষাঢ় (আশাঢ়)।
৫১. ঙ অর্ধস্বরবর্ণ না তাই এর উচ্চারণ ‘উয়/উঁয়ো/উমা না হয়ে হবে ব্যঞ্জনঘেষা উঙ হবে। ঙ শব্দের শুরুতে বসে না। ঙ ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হতে পারে। যেমন: ঙ-এর উচ্চারণ উঙো কিন্তু ব্যবহারিক উচ্চারণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন: অং-বং, আং-বাংলা, আঙা- বাঙালি, অঙি-রঙিন ইত্যাদি।
* ঙ অনেক সময় ঙা/ঙে/ঙু/অং উচ্চারিত হয়। যেমন: স্বরকার যুক্ত বর্ণে ঙ-বাঙালি, রঙের, আঙুর।
* স্বরকারহীন বর্ণে ঙ ধ্বনি ‘ং’ এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : বাংলা, অহংকার, বংগবন্ধু, অংগিকার, সংগি।
* ঙ-এর পরে প্রত্যয়, বিভক্তি বা কারচিহ্ন যোগ হলে ‘অঙ’ উচ্চারিত হয়। যেমন: বাংলা-বাঙালি, রং-রঙিন, রঙের, আঙুর।
* সন্ধিযুক্ত শব্দে ‘ঙ’ ধ্বনি ‘অং’ উচ্চারিত হয়। যেমন: অহংকার, ভয়ংকর, সংগীত।
* ‘ঙ’ ধ্বনি শব্দের শেষে অং/ওং, ইং, আং উচ্চারণ হয়। যেমন: রং, ঢং, সং, এবং, চোং, স্বয়ং, শিং, সুতরাং।
৫২. সংস্কৃত শব্দে ‘জ’ উচ্চারণ সংক্ষিপ্ত আর ‘য’ উচ্চারণ সামান্য দীর্ঘ তবে বাংলায় এদের উচ্চারণ এক রকম। যেমন: জড়, জীবন, যতি, যম, যাত্রা। ‘য’ উচ্চারণ ‘জ’-এর মতো। য-ফলা হলো য-এর সংক্ষিপ্তরূপ।
* য-ফলা প্রথমে এ্যা-কার হয়। যেমন: জ্যান্ত আর মাঝে ও শেষে দ্বিত্ব হয়। যেমন: কল্যাণ (কোললান) ও পদ্য (পোদদো)।
* সমাপিকা ক্রিয়া হলে য-ফলা প্রথমে এ্যা-কার হয় উচ্চারিত হয়। যেমন : লেখে (ল্যাখে)।
* বিদেশি শব্দে ‘জ’ বসে জ উচ্চারিত হয়। যেমন: গজল, মজবুত, দরজা, কাগজ, আজান, ওজু, আজাব।
৫৩. ব হলো প-বর্গের তৃতীয় বর্ণ। প-বর্গীয় ব'কে বর্গীয় ‘ব’ বলে। ‘ব’ ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হতে পারে। যেমন :
* ব-এর স্বাভাবিক বানানে উচ্চারণ: আব্বা, জব্বার, উদ্বোধন, উদ্বিগ্ন, উদ্বাস্তু, উদ্বৃত্ত, দিগ্বলয়, দিগ্বিজয়, লম্বা, বিম্ব, সম্বোধন।
* ব-এর দ্বিত্ব উচ্চারণ। যেমন : বিশ্ব, নিজস্ব।
* বর্গীয় ‘ব’ যদি ব-ফলা হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাহলে ‘ব’ উচ্চারিত হয়। যেমন: বিশ্ব, বাল্ব, উদ্বেল।
* অন্তঃস্থ ব’কে সংস্কৃতে ‘ওয়া’র মতো উচ্চারিত হয় কিন্তু বাংলায় এর কোন উচ্চারণ নাই। যেমন: স্বাধীন (সোয়াধিন), স্বাগতম (সুয়াগতম)।
* সংস্কৃত ব-ফলা যুক্তবর্ণ কখনো অনুচ্চারিত থাকে। যেমন: ধ্বনি, জ্বালা, স্বদেশ, স্বাগতম, তত্ত্ব, উজ্জ্বল। ব-ফলা যুক্তবর্ণ কখনো দ্বিত্ব উচ্চারিত হয়। যেমন: কবিত্ব, বিশ্ব।
* উদ-এর সঙ্গে ‘ব’ থাকলে ‘ব’ উচ্চারিত হয়। যেমন: উদ্বিগ্ন, উদ্বেল, উদ্বৃত্ত, উদ্বোধন ইত্যাদি।
৫৪. ‘ম’ হলো প-বর্গের পঞ্চম বর্ণ। ‘ম’ সরাসরি বসে আবার ম-ফলা হিসেবে বসে। ‘ম’ ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হতে পারে।
* দ্বিতীয় বর্ণে ‘উ/উ/ও ধ্বনি থাকলে ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন: মউ (মোউ), মলি (মোলি), মধু (মোধু)।
* ম-ফলাযুক্ত বানানে ‘ম’ অনুচ্চারিত থাকে। যেমন: স্মরণ, স্মৃতি, স্মারক।
* ম-ফলাযুক্ত বানানে ম উচ্চারিত হয়। যেমন: গুল্ম, জন্ম, সম্মান, মৃন্ময়, উন্মাদ, কুষ্মাণ্ড, সুস্মিতা, কাশ্মির।
* ম-ফলাযুক্ত বানানে ‘ম’ লিখিত বর্ণের দ্বিত্ব উচ্চারিত হয়। যেমন: আত্ম, আত্মা, ছদ্ম, পদ্ম, রশ্মি, বিস্ময়।
৫৫. ঋ-কার যুক্ত বর্ণ দ্বিত্ব উচ্চারণ না হয়ে এককভাবে উচ্চারিত হয়। যেমন: আবৃত্তি>আ-বৃৎ-তি /আববৃৎতি নয়। প্রকৃতি—প্র-কৃ-তি। মাতৃভূমি—মা-তৃ-ভূমি, অমৃত, অদৃষ্ট, অদৃশ্য, আকৃষ্ট প্রকৃতি, প্রাকৃতিক, মাতৃভাষা। আবার দ্বিত্ব উচ্চারিত হচ্ছে। যেমন: মসৃণ (মোসসৃন), আদৃত (আদদৃতো)।
* অন্যবর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে ‘ঋ’ উচ্চারতি হয় র-ফলার মতো। যেমন: হৃদয় (রিদয়/হ্রিদয়), আদৃত (আদ্রিত), খ্রিস্টাব্দ (খৃস্টাব্দ), বিকৃত (বিক্রিত)।
* সংস্কৃত ব্যাকরণবিদগণ ঋ’কে দীর্ঘ উচ্চারণ ধরে ঋযুক্ত অনেক বানানকে ঈ-কার দিয়ে লিখেছেন। যেমন: গ্রীষ্ম (গ্রিশশো), তীক্ষ্ণ (তিখনো)।
৫৫. সংস্কৃতি ‘য়’ নাই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর য-এর নিচে বিন্দু বসিয়ে তৈরি করলেন ‘য়’ যা ‘অ’ ধ্বনির মতো না। সংস্কৃতের ‘নিযম’ বাংলা হলো ‘নিয়ম’। প্রাকৃত বা চর্যাপদেও ‘য়/য়া’ নাই আছে ‘অ/আ’।
* ‘য়া’ অনেক সময় ‘আ’ ধ্বনির মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : খাওয়া (খাওআ)।
* ‘য়’ উচ্চারণের সময় ‘অ/আ’ উচ্চারিত হয়। সময় (সমঅয়), মায়া (মায়আ), কায়া (কায়আ)।য়-আ টেনে টেনে উচ্চারণ করতে হয়, কায়-আ উচ্চারিত হবে না। আগে ‘য়’ দিয়ে কিছু বিদেশি শব্দ শুরু হত কিন্তু এখন ‘ইউ’ দিয়ে হয়। যেমন: য়ুরোপ (ইউরোপ), য়ুসুফ (ইউসুফ), য়ুনানি (ইউনানি) ইত্যাদি।
* ‘য়ে’ সব সময় ‘এ’ উচ্চারিত হয়। যেমন: দিয়ে (দিএ), নিয়ে (নিএ), মায়ে (মাএ-মায়-এ হবে না)। শব্দের শেষে স্বরবর্ণ (স্বরচিহ্ন নয়) থাকলে বিভক্তি ‘এর’ পরিবর্তে ‘য়ের’ বসে। কিন্তু উচ্চারিত হবে ‘এর’। যেমন: বইয়ের, বউয়ের, ভাইয়ের-ভায়ের, মায়ের।
৫৬. বাংলা শব্দে ‘শ, ষ, স’ বর্ণের সঠিক ব্যবহার বিধিকে ষত্ববিধান বলে। ‘শ/ষ/স’ তিনটি বর্ণের উচ্চারণ বর্ণমালায় একই। তিনটি নাম ভিন্ন। যেমন : তালব্য শ-শাপলা/শ্রম, মূর্ধন্য শ-ষাঁড় আর দন্ত শ-সিংহ/স্রষ্টা। অনেক সময় ‘স’-এর উচ্চারণ ছ-এর মতো না হয়ে হয় ছ-এর মাঝা মাঝি। তবে শব্দে বসলে স বা শ-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন:
* ‘শ’ মুক্ত অবস্থায় সব সময় শ উচ্চারিত হয়। যেমন: শক্তি (শোকতি), শহিদ (শোহিদ), শান্ত (শানতো), শিক্ষা (শিকখা), শিতল (শিতোল), শূন্য (শুননো), শেষ (শেশ), শৈশব (শোইশব) ইত্যাদি।
* ‘শ’-এর সাথে ল, র-ফলা বা ঋ-কার যুক
0 comments:
Post a Comment