এক অন্যরকম উত্তরপত্র

Wednesday 3 May 2017

বাক্যের পদক্রম

বাক্যের পদক্রম

ভাষার মূল উপাদান বাক্য আর বাক্যের মৌলিক উপাদান শব্দ। বাক্য তৈরি করতে শব্দ ও শব্দ বসালেই হবে না। সার্থক শব্দক্রম বা পদক্রম করেই বাক্য বানাতে হয়। একটি সার্থক বাক্যের পদক্রমে তিনটি গুণ বিদ্যমান থাকা জরুরি। যেমন: আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি ও যোগ্যতা। বাক্যের সার্থক পদক্রমকে কৌশলের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়। যেমন :

ক) আকাঙ্ক্ষা : সম্পূর্ণ বাক্য হলো আকাঙ্ক্ষা।
বাক্যের অর্থ পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য এবং বাক্যকে সম্পূর্ণ করার জন্য এক পদের পর অন্য পদ বা খণ্ডবাক্য শোনার যে ইচ্ছা তাই আকাঙ্ক্ষা। আকাঙ্ক্ষা হলো বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণভাবে বুঝার জন্য পরবর্তী পদ শোনার ইচ্ছা। যেমন: বল বীর বল ...এর পরের কথা না বললে আকাঙ্ক্ষাহীন বাক্য হবে। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে...। সে লেখাপড়া কোরে...। বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এবং বাক্যকে সম্পূর্ণ করার জন্য, প্রথম বাক্যের সঙ্গে ‘ঘোরে’ এবং দ্বিতীয় বাক্যের সঙ্গে ‘ভাল চাকরি করবে বা জ্ঞানী হবে’ খণ্ড বাক্যের দরকার হয়।

খ) আসত্তি : শৃংখলাবদ্ধ শব্দ বা পদ হলো আসত্তি।
শৃঙ্খলাবদ্ধ শব্দ/পদকে আসক্তি বলে। বাক্যের অর্থসঙ্গতিরক্ষার জন্য সুশৃংখল পদবিন্যাসকেই আসত্তি বলে। আসত্তি হলো বাক্যের স্পষ্ট মনোভাব প্রকাশের জন্য পদসমূহকে যথাস্থানে সাজানো। কবিতার ক্ষেত্রে আসক্তির হেরফের হতে পারে। হয়েছেও। ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, তরী সে ছোটো /আমার ধানে সোনার গিয়েছে ভরি’, লেখলে বাক্যের আসত্তি থাকে না। আসত্তি তখনই থাকে যখন লেখা হয়, ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী /আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

গ) যোগ্যতা : অর্থর ও ভাবের সমন্বয় হলো যোগ্যতা।
অর্থ ও ভাবের সমন্বয়কে যোগ্যতা বলে। বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ অর্থগত ও ভাবগত মিল বন্ধনকে যোগ্যতা বলে। ‘মসজিদে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়’ লিখলে বাক্যের যোগ্যতা হারায় তাই বাক্যের যোগ্যতা রক্ষা করার জন্য লিখতে হবে, ‘মসজিদে নামাজ কায়েম করা হয়’। যোগ্যতা হলো বাক্যে ব্যবহৃত পদসমূহের অর্থ ও ভাবের সেতুবন্ধন। বিভিন্নভাবে বাক্যের যোগ্যতা হারাতে পারে। শব্দের অবস্থান এবং বাক্যের অবস্থান ঠিক রেখে বাক্যে যোগ্যতা ঠিক রাখা যায়। যেমন :
i. শব্দের অবস্থান ঠিক রাখা
ii. বাক্যের অবস্থান ঠিক রাখা
১. শব্দরূপান্তরে খেয়াল রাখা 
২. শব্দদ্বিত্ব ব্যবহার ঠিক রাখা
৩. বাহুল্য বা বচন দোষমুক্ত রাখা
৪. নির্দেশকের ব্যবহার ঠিক রাখা
৫. সন্ধির ব্যবহার ঠিক রাখা
৬. সমাসের ব্যবহার ঠিক রাখা
৭. উপসর্গের ব্যবহার ঠিক রাখা
৮. বিভক্তির ব্যবহার ঠিক রাখা
৯. প্রত্যয়ের ব্যবহার ঠিক রাখা
১০. চিহ্নের ব্যবহার ঠিক রাখা
১১. পক্ষের ব্যবহার ঠিক রাখা
১২. বিসর্গের ব্যবহার ঠিক রাখা
১৩. সমোচ্চারিত শব্দের ব্যবহার ঠিক রাখা
১৪. ক্রিয়ার সঠিক ব্যবহার    
১৫. প্রমিত বানানের দিকে খেয়াল রাখা 
১. কারকের ব্যবহার ঠিক রাখা
২. বাচ্যের ব্যবহার ঠিক রাখা
৩. এককথায় প্রকাশের ব্যবহার ঠিক রাখা
৪. প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার ঠিক রাখা
৫. বাক্যের শৃংখলা বজায় রাখা
৬. বাগধারার ব্যবহার ঠিক রাখা
৭. রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা বজায় রাখা
৮. প্রাঞ্জলতা (সহজবোধ্য বাক্য) বজায় রাখা
৯. অর্থব্যক্তি বজায় রাখা
১০. গুরুচণ্ডালী মুক্ত রাখা
১১. যতির ব্যবহার ঠিক রাখা


i. শব্দের অবস্থান ঠিক রাখা
শব্দের অবস্থান ঠিক রেখে বাক্যের গুণ রক্ষা করা যায়। বাংলাবাক্যের বড়গুণ শব্দকে বিভক্তি যুক্ত করে যেখানে সেখানে বসানো যায় তবুও শব্দ অবস্থানগত কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। যেমন:
১. শব্দরূপান্তরে খেয়াল রাখা
শব্দরূপান্তর খেয়াল রেখে পদ সাজাতে হয়। যেমন: দীন>দৈন্য>দীনতা হয় কিন্তু যদি দৈন্যতা ব্যবহার করা হয় তাহলে ব্যর্থ বাক্যে পরিণত হয়। কারণ একই শব্দে ‘তা ও য-ফলা ব্যবহার করে বিশেষ্য হয় না। এছাড়া এগুলোই ভুল শব্দ-মাধুর্যতা, উৎকর্ষতা, সৌজন্যতা, সমসাময়িক, উদ্বেলিত, চোখের দৃষ্টিশক্তি, মাতাহারা।
২. শব্দদ্বিত্বের ব্যবহার ঠিক রাখা
একই শব্দের দ্বিত্ব ব্যবহারে বহুবচন প্রকাশ পায় আবার অর্থহীন হয়ে যায়। অর্থহীন হলে সেটি হবে ব্যর্থ পদক্রম। যেমন: শুধুমাত্র, কেমলমাত্র, অশ্রুজল, ঘামজল, ভুলত্রুটি, ভুলভ্রান্তি। বিভিন্ন প্রকার শব্দ বা পদ দুবার ব্যবহার করে শব্দ বানাতে পারি। কিন্তু অর্থের দিকে খেয়াল করতে হয়। যেমন: ফলাফল (ফল + অফল) শব্দটি ঠিক ব্যবহার কিন্তু এর প্রতিশব্দ হিসেবে লেখা হয় ফলশ্রুতিতে’ তাহলে শব্দটি হবে ভুল। কারণ ‘ফলশ্রুতি’ অর্থ ‘শ্রবণ’ কোন বিষয়ের ফল নয়। ‘ভাষাভাষী’ অর্থ কোন একটি ভাষা ব্যবহারকারী। তাই ভাষাভাষীর পূর্বে কোন ভাষার নাম উল্লেখ করে লিখলে তা হবে ভুল। যেমন: বাংলা ভাষাভাষী। এমন কিছু দ্বিত্বশব্দ তৈরি করা হয় যা ভুল। যেমন: ভেদাভেদ, গুণাগুণ ইত্যাদি। এদের মধ্যে ভালোমন্দ দুটিই থাকে। যেমন: ভেদ+অভেদ বা গুণ+অগুণ। এদের অপপ্রয়োগ আজ প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে। বলা হচ্ছে ‘ভেদাভেদ ভুলে গেছে’ যা ভুল। আবার বলা হচ্ছে ‘আমাদের পন্যের গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা সচেতন’। আসলে হবে ‘ভেদ বা গুণ’। শব্দদ্বিত্ব কোন সময় একবচন আবার কোন সময় বহুবচন প্রকাশ পায়। এরা আলাদা বসে আবার হাইফেনযুক্ত হয়ে বা একশব্দেও বসতে পারে। তাই বাক্যে ব্যবহারের সময় এদিক খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় কবিগণ দুটি বিশেষ্য ব্যবহার করেন যা ত্রুটিপূর্ণ বলে অনেকেই সমালোচনা করেন। কিন্তু কবি যদি তাঁর ব্যবহৃত দুটি শব্দের প্রথম বিশেষ্য দিয়ে বিশেষণ এবং দ্বিতীয় বিশেষ্য দিয়ে বিশেষ্য বুঝাতে পারেন তাহলে ব্যবহার ত্রটিপূর্ণ হবে না। যেমন: তনু ও দেহ একই অর্থ অর্থাৎ শরীর অর্থ বহন করে তবে এখানে তনু— নমনীয়/কমনীয়/সরু অর্থ প্রকাশ করছে। শুভ্রসাদা=শুভ্র ও শাদা একই অর্থ বহন করে তবে এখানে শুভ্র—ধবধবে /অতিশয় শাদা/উজ্জ্বল অর্থ প্রকাশ করছে। কিন্তু অশ্রুজল দিয়ে তেমন বোঝায় না। অশ্রু অর্থ চোখের জল কিন্তু অশ্রু দিয়ে জলের কোন বিশেষণ প্রকাশ করছে না। ঘামজলে তার শার্ট ভিজে গেছে না হয়ে হবে ঘামে তার শার্ট ভিজে গেছে। অশ্রুজলে তার কপল ভিজে গেছে না হয়ে হবে অশ্রুতে তার কপল ভিজে গেছে।
৩. বাহুল্য দোষমুক্ত রাখা/বচন ব্যবহার ঠিক রাখা
শব্দের সংখ্যাগত ও পরিমাণগত ধারণাই (এক, অনেক বা কম, বেশি) বচন। সংখ্যা বা পরিমাণের ধারণা যদি একবার বহু দিয়ে বুঝানো যায় তাহলে দুবার বহুবচনচিহ্ন ব্যবহার করার দরকার হয় না। সংস্কৃত বা ইংরেজি বাক্যে সকল ছাত্রছাত্রীবৃন্দ বা All students বসে কিন্তু বাংলাতে এমন ব্যবহার ত্রুটিপূর্ণ। শব্দদ্বিত্বের মাধ্যমেও বহুবচন প্রকাশ করা হয় তাই শব্দদ্বিত্বের পরে বহুবচনচিহ্ন বসে না। যেমন: ‘পাকা পাকা কথাগুলো’ ছোট ছোট গ্রামগুলো, ছোট ছোট সব গ্রামগুলো ইত্যাদি। বিভিন্নভাবে শব্দদিত্ব হতে পারে। যেমন:
বিশেষ্য—লোকে লোকে, দ্বারে দ্বারে।
বিশেষণ—ছোট ছোট, বড় বড়।
সর্বনাম—যারা যারা, কে কে।
যোজক—যখন যখন, সহচর-অনুচর, বন্ধু-বান্ধব।
ক্রিয়া—লেনদেন, বকাঝকা, খেলাধুলা, লালনপালন, খোঁজখবর, হেঁটে হেঁটে, খেয়ে খেয়ে, বলে বলে।
ক্রিয়াবিশেষণ—ধীরে ধীরে, ফিরে ফিরে, আস্তে আস্তে ইত্যাদি।
৪. নিদের্শকের ব্যবহার ঠিক রাখা
‘টা/টি/খানা/খানি’ ব্যবহার করে শব্দকে নির্দিষ্ট করলে তার আগে ‘এই’ বা ‘ঐ’ ব্যবহার করা যায় না। যেমন: ‘এই ছেলেটি কার’ না হয়ে হবে ‘এই ছেলে কার বা ছেলেটি কার?’
৫. সন্ধির ব্যবহার ঠিক রাখা
সন্ধি শব্দ গঠনের শক্তিশালী মাধ্যম তবে সংস্কৃত ও সংস্কৃত শব্দে সন্ধি করতে হয়। সংস্কৃত ও বাংলা শব্দের সন্ধি হয় না। বাংলা ও বাংলা শব্দে সন্ধি না করে আলাদা লেখাই ভালো। উচ্চারণে সুবিধা করতে গিয়ে শব্দকে অশুদ্ধ করা ঠিক নয়। যেমন: লজ্জাস্কর না হয়ে হবে লজ্জাকর /লজ্জাজনক। আবার লিখতে হবে ‘মিশি কালো>মিশকালো, নাতি বউ>নাতবউ, নাত জামাই> নাজ্জামাই, ঘোড়া দৌড়> ঘোড়দৌড়, পিছে মোড়া>পিছমোড়া’ কিন্তু লেখা যাবে না ‘বচ্ছর, কুচ্ছিত, উচ্ছব, ঘোড়গাড়ি’।
৬. সমাসের ব্যবহার ঠিক রাখা
সমাসবদ্ধ শব্দ হলে একশব্দে লিখতে হবে। অথবা মাঝে হাইফেন দিতে হবে।র দিয়ে দুটি শব্দ যুক্ত হলে শব্দ দুটি এ-বিভক্তিযুক্ত হতে হবে। সহ অর্থ বুঝালে ‘স্ব’ না বসে ‘স’ বসে। সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের সমাস হয়। সমাসজাত শব্দ ও ব্যসবাক্য একই সঙ্গে বসে না। সমাসবদ্ধ শব্দের বানানে শুধু মাঝের ঈ-কার ই-কার হয়। দুটি শব্দে বিভক্তি/নির্দেশক, প্রত্যয় (ই/ঈ/ইতা-প্রত্যয় বাদে), সন্ধি (বানান পরিবর্তন হয়), উপসর্গ যোগ করলে বানানের এমন কী বর্ণের কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন: নারীকে, নারীতে, নারীটি, নারীগুলো, নারীগণ কিন্তু পরিবর্তন হবে নারিবাচক বা নদিমাতৃক শব্দে। এখানে ‘নারী’+বাচক ও নদি+মাতৃক’ দুটি অর্থবোধক শব্দ)। ‘বনজ’ একটি সমাসজাত শব্দ। এই সূত্র বর্তমানে লেখা হচ্ছে ‘ফলজ’। ‘বনজ’ ব্যাসবাক্য করলে হয় ‘যা বনে জন্মে’। এ জাতীয় বহু সমাসজাত শব্দ রয়েছে। যেমন: জলজ, পঙ্কজ, অগ্রজ ইত্যাদি। কিন্তু ‘ফলজ’ ব্যাসবাক্য করলে হয় ‘যা ফলে জন্মে’ যা ভুল। শুদ্ধ করে লিখতে চাইলে লিখতে হবে ‘ফলদায়িগাছ। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধ ও ভাতে’ না লিখতে হবে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ও ভাতে’।
অর্থর গঠন অনুসারে শব্দ এককভাবে বা আলাদাভাবে বাক্যে বসে। যেমন: উড়া উড়ি (উড়াউড়ি), হয়না (হয় না), কথানয় (কথা নয়), হয় নি (হয়নি), এমনই (এতই, পরিমাণ, এরকমই), এমনি (অকারণ/শুধু শুধু), একরকম (সংখ্যা), একরকম (কোনভাবে), কোন ভাবে (কোনভাবে), তার পর (after that), তারপর (then তখন), নয় তো (কারণ/সময়), নয়তো (বিকল্প/ সম্ভাব্য, নিশ্চিত/অনিশ্চয়তা), না হয় (না বোধক) নাহয় (বরং নাহলে (অন্যথায় /অথবা /ছাড়া), কেন না (কেনো না বললে), কেননা (যেহেতু)
৭. উপসর্গের ব্যবহার ঠিক রাখা
উপসর্গে হাইফেন বসে না। যেমন: উপ-সচিব। ‘অ’ যদি নাবোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাহলে সেই শব্দের শেষে হীন যুক্ত হয় না। যেমন: অসচেতনহীনভাবে, অক্লান্তি হীনভাবে। ফুল দিয়ে তাঁকে সুস্বাগতম জানানো সবার কর্তব্য। ফুল দিয়ে তাঁকে স্বাগতম জানানো সবার কর্তব্য। অক্লান্তি হীনভাবে প্রজন্ম চত্বরে সমায়েত হচ্ছে। ক্লান্তি হীনভাবে প্রজন্ম চত্বরে সমায়েত হচ্ছে।
৮. বিভক্তির ব্যবহার ঠিক রাখা
শব্দের সঙ্গে বিভক্তি বসে পদেরূপান্তরিত হয়। একটি বাক্যে যেমন একাধিক বহুবচন চিহ্ন বাক্যের গুণকে নষ্ট করে তেমনি একটি শব্দে বহু বিভক্তিও (সপ্তমী/ষষ্ঠী) বাক্যের গুণকে নষ্ট করে। সামান্য সচেতনতায় এই দোষ গুণে পরিণত হতে পারে। দুটি বিভক্তি না বসিয়েও কিন্তু বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকে না। একই পদে দুটি বিভক্তি বসে না তবুও ব্যবহার করা হয়। কে একাধিক কারকে ব্যবহৃত হয় বলে একে তির্যক বিভক্তি বলে। তবে যে কারকেই ব্যবহৃত হোক না কেনো সেটি হতে হবে একবচনে। বহুবচনজাতীয় শব্দে ‘কে’ বসে না। যেমন: তাদেরকে দিয়ে একাজ করিও না। আমাদেরকে অনেক কষ্ট করে শুটিং করতে হয়েছে। সব পাগোলগুলোকে দিয়ে ক্লাস নেয়। একশব্দে দুটি বিভক্তি বসলে শব্দের গুণ হারায়। যেমন: তোমার কথায় বুকেতে আঘাত পাই। গেলাসে করে দুধ দাও। বস্তুবাচক একবচন পদে কোন বিভক্তি (কে, রে) বসে না। যেমন: ঘড়িকে হাতে দাও। বইকে পড়ো। এই কলমটাকে দিয়ে ভালো লেখা হয়। সংস্কৃত বিভক্তিতে তাহাদিগকে, আমাদিগকে ব্যবহার করা হয়। সংস্কৃত ব্যাকরণে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাসে বস্তু বা প্রাণিবাচক কর্তায় ‘কে’ বসানো হচ্ছে। যেমন: বইকে পড়া=বইপড়া, গানকে শোনা=গানশোনা, সাপকে ধরা=সাপধরা, মাছকে ধরা=মাছধর, রথকে দেখা, ভয়কে প্রাপ্ত, কাপড়কে কাঁচা, ভাতকে রাঁধা, নথকে নাড়া, স্বর্গকে প্রাপ্ত ইত্যাদি কিন্তু আমরা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এমন ব্যবহার করি না। শুধু এই বিভক্তিতেই ব্যবহার করে থাকি।
৯. প্রত্যয়ের ব্যবহার ঠিক রাখা
কোন শব্দের সঙ্গে কোন প্রত্যয় যুক্ত হয় তা খেয়াল রেখেই শব্দ তৈরি করতে হয়। ভুল প্রত্যয়ের ব্যবহারের কারণে বানান ভুল হয়ে যায়। আর বানান ভুল হলে বাক্যের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই প্রত্যয় ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হয়। একই শব্দের সঙ্গে দুটি প্রত্যয়চিহ্ন বসে না। বিভক্তি না দেয়ার কারণে যেমন বাক্যের গুণ নষ্ট হয়ে যায় আবার বেশি দিলেও গুণ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন: এতটুকু মেয়ে কলেজ পড়ে, তোমার কথায় বুকেতে আঘাত পাই। তার সঙ্গে আমার সখ্যতা (সখ+য-ফলা+ তা) আছে। এটি তার দৈন্যতা।
১০. চিহ্নের ব্যবহার ঠিক রাখা
∙ সংস্কৃতিতে বিশেষণ ও বিশেষ্য দুটিকেই চিহ্নের আওতায় আনা হয়। যেমন: নর— সুন্দর বালক আর নারী— সুন্দরী বালিকা কিন্তু বাংলাতে বিশেষণকে ঠিক রেখে শুধু বিশেষ্যকে নর বা নারী প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ বাংলায় বিশেষণকে নারী বাচক করার দরকার হয় না। যেমন: সুন্দর বালক এবং সুন্দর বালিকা।
∙ সংস্কৃতিতে দুটি বিশেষ্যকেই চিহ্নের আওতায় আনা হয়। যেমন: মেয়েটি পাগলি, আসমা অস্থিরা কিন্তু বাংলাতে দুটি বিশেষ্যের একটিকে নারিচিহ্নের আওতায় আনা হয়। যেমন: মেয়েটি পাগল, আসমা অস্থির ইত্যাদি।
∙ সংস্কৃতিতে ঈ বা ইনি বা নী প্রত্যয়ই একসঙ্গে বসে কিন্তু বাংলায় বসে না। যেমন: অভাগা— অভাগী— অভাগিনী, ননদ— ননদী— ননদিনী, কাঙাল— কাঙালী— কাঙালিনী, গোয়াল— গোয়ালী— গোয়ালিনী কিন্তু বাংলায় অভাগি, ননদি, মায়াবি, কাঙালি, গোয়ালি, বাঘি বা বাঘিনি। তবে ক্লীববাচক শব্দে নী প্রত্যয় যুক্ত করে নারী বাচক শব্দ তৈরি করতে হয়। যেমন: মেধাবিনী, দুখিনী, যোগিনী, মায়াবিনী ইত্যাদি।
∙ সংস্কৃতিতে ক্ষুদ্রার্থবাচক কিছু ক্লীববাচক শব্দকে নর বা নারী বাচক করা যায় যা বাংলাতে সঠিক নয়। যেমন: নাটক— নাটিকা, উপন্যাস— উপন্যাসিকা, পুস্তক — পুস্তিকা, গীতি— গীতিকা ইত্যাদি।
∙ সংস্কৃতিতে নরবাচক শব্দ— বৃক্ষ, নারী বাচক শব্দ— লতার ক্লীববাচক শব্দ— জল আবার হিন্দিতে নরবাচক শব্দ—রুটি আর নারী বাচক শব্দ— দই।
∙ বাক্য দেখে নির্ণয় করতে হয় কোনটি নর আর কোনটি নারী বাচক শব্দ। যেমন: গরু গাড়ি টানে। গরু দুধ দেয়। সে/তিনি গর্ভবতী, সে কৃষিকাজ করে। বাংলায় সংস্কৃতের মতো ব্যবহার না করে এমন করে ব্যবহার করি।রহিমা খুব সুন্দর। সেলিনা হোসেন একজন বিদুষী লেখক।
১১. পক্ষের ব্যবহার ঠিক রাখা
প্রথমপক্ষ যদি অন্যপক্ষের সঙ্গে একই বাক্যে ব্যবহৃত হয় তাহলে ক্রিয়া প্রথমপক্ষ অনুসারে হয়। একশেষ হলে নিয়ম অনুসারে প্রথমে সে, তুমি ও আমি বসে আর ক্রিয়া প্রথমপক্ষ অনুসারে হয়। আগে কবিতার বাক্যের ক্ষেত্রে কবিগণ পক্ষ অনুসারে ক্রিয়ার ব্যবহার ঠিক রাখেন নাই। যেমন: হাসঁগুলো যায় ভাসি। বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই। কারণ সংস্কৃত ‘ভাসিয়া’ থেকে ‘ভাসি’ চলিত হয়েছে। আমি অর্থাৎ হাসান জেনে শুনে ভুল করি না। আমি অর্থাৎ হাসান জেনে শুনে ভুল করে না। আমি, সে আর তুমি কাজটি করব। সে, তুমি আর আমি কাজটি করব।
১২. বিসর্গের ব্যবহার ঠিক রাখা
বাংলার বিসর্গ একটি বর্ণ তাই বিসর্গের স্থানে কোলন বসানো যাবে না। যেমন: পুন:প্রচার।
১৩. সমোচ্চারিত শব্দের ব্যবহার ঠিক রাখা
উচ্চারণের দিক থেকে এক হলেও অর্থের দিক থেকে ভিন্ন। বাক্যের অর্থ ঠিক রাখতে সমার্থক শব্দের সঠিক ব্যবহার জরুরি। তাড়া আমরাতলায় বসে আমরা খাওয়ার সময় মালির তারা খেয়েছে’ লিখলে বাক্যের অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হতে হয় কিন্তু যদি লিখি ‘তারা আমড়াতলায় বসে আমড়া খাওয়ার সময় মালির তাড়া খেয়েছে’ অর্থ সহজ হয়ে যায়।
১৪. ক্রিয়ার ব্যবহার ঠিক রাখা
ক্রিয়ার অবস্থান পরিবর্তন করা যাবে। যেমন: জিজ্ঞাসিব জনে জনে অথবা জনে জনে জিজ্ঞাসিব অথবা আমি জিজ্ঞাসিব জনে জনে। তবে সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহারটা প্রচণ্ডভাবে খেয়াল করা উচিৎ। অসমাপিকাকে সমাপিকা করতে দুইটি ক্রিয়া লাগে।
১৫. প্রমিত বানানের দিকে খেয়াল রাখা
ভুল বানান বাক্যের গুণ নষ্ট করে। বানান ঠিক করে কথা বলা বা লেখা রুচিশীল ব্যাপার। সংস্কৃত শব্দকে তদ্ভব করলে এখানে ঈ-কার হয়ে যায় ই-কার। ঊ-কার হয়ে যায় উ-কার। ণ-হয়ে যায় ন। য-ফলা থাকে না। যেমন: বৈশাখী-বোশেখি, সূর্য-সুয্যি, পূর্ব-পুব, প্রাণ-পরান, কৃষাণ-কিষান/কিশান, বর্ণ-বরন, স্বর্ণ-সোনা, সন্ধ্যা-সন্ধে, শূন্য-শুন্যি। সন্দেহযুক্ত শব্দের শেষের-কার ব্যবহার করা। যেমন: মত, মতো। সমাপিকা ক্রিয়া হলে ও-কার প্রথম বর্ণের সঙ্গে যোগ না হয়ে অসমাপিকা ক্রিয়া হলে প্রথম বর্ণের সঙ্গে ও-কার যোগ হয়। উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে লিখিতরূপও এমন হতে পারে। যেমন:সে কাজটি করে। ‘করে’ ক-এর সঙ্গে ও-কার হবে না। কিন্তু সে কাজটি কোরে বাসায় যাবে। ‘করে’ ক-এর সঙ্গে ও-কার যোগ হবে। ও-কার ও উ-কার এর ক্ষেত্রেও উচ্চারিত হবে। আকাশে চাঁদ ওঠে। আকাশে চাঁদ উঠে জোছনা দেয়। সে বাগান থেকে ফুল তোলে। সে বাগান থেকে ফুল তুলে বাজারে বিক্রি করে। কিন্তু শব্দের শেষ বর্ণে যদি আ-কার থাকে তাহলে কোন পরিবর্তন হবে না। পাল তোলা/তুলা সব নাও। যেমন: কুটা-কোটা, খুঁটা-খোটা, শুনা-শোনা। য-ফলা প্রথমে থাকলে এ্যা-কার হয়। যেমন: জ্যান্ত। মাঝে ও শেষে দ্বিত্ব হয়। যেমন: কল্যাণ (কোললান), পদ্য (পোদদো)। আরও বলা যায়, যুক্তবর্ণ ভাঙলে শেষ বর্ণে ও-কার যুক্ত হয়। তবে বিশেষণ থেকে বিশেষ্য তৈরিকৃত শব্দ বাদে যুক্ত বর্ণে য-ফলা ব্যবহার না করা যেতে পারে। যেমন: অর্ঘ্য, লক্ষ্য, অন্ত্য, অন্ত্যমিল, উত্ত্যক্ত, গার্হস্থ্য, সন্ধ্যা, সামর্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, সৌহার্দ্য, স্বাতন্ত্র্য, স্বাস্থ্য ইত্যাদি। আবার সংস্কৃত শব্দ বলে, প্রথম বর্ণের পর য-ফলা ব্যবহৃত হয়। যেমন: জ্যেষ্ট, জ্যোষ্ট, জ্যৈষ্ঠ, দ্যুতি, জ্যোৎস্না, দ্যোতনা, ন্যূন ইত্যাদি। সংস্কৃত শব্দের এদের গুরুত্ব আছে কিন্তু বাংলা শব্দে নাই। বিশেষণ থেকে বিশেষ্য করতেও য-ফলা ব্যবহার করা হয়। যেমন: দীন-দৈন্য, বিচিত্র-বৈচিত্র্য। প্রাদেশিক ও বিদেশি শব্দ হলে /ছ/য/ণ/ষ/ঞ্জ/ঞ্চ/ঈ-কার/উ-কার বসে না। যেমন: লুংগি, ডেংগু, ঠান্ডা, ঝান্ডা, লন্ঠন, মিসরি, পসন্দ, নামাজ, ওজু, ইস্টার্ন, স্টোর, ইনজিন, ইনজিনিয়ার, সেনচুরি, তির (ধনুক অর্থে, পাড় অর্থে নয়), অ্যাকাডেমি/এ্যাকাডেমি/একাডেমি, রসুল, নুর ইত্যাদি। সংস্কৃত শব্দে য-ফলা চল আছে কিন্তু ইংরেজি শব্দে নাই তবু লেখা হচ্ছে। যেমন: ইস্যু, টিস্যু, গ্যেটে, স্যার। ইংরেজি কিছু শব্দ আছে যা সিলেবল করে বাংলায় না লেখা হলে বানান গোলমাল মনে হয়। যেমন: Degree>ডিগ্রি>ডিগরি, February>ফেব্রুয়ারি>ফেবরুয়ারি, April>এপ্রিল>এপরিল। ইংরেজি শব্দকে তদ্ভব করে লেখা হচ্ছে। যেমন: হসপিটাল>হাসপাতাল, চকোলেট> চকলেট।
ii. বাক্যের অবস্থান ঠিক রাখা
গদ্যের বাক্যগঠন: কর্তা +কর্ম +ক্রিয়া = আমি ছড়া লেখি।
কাব্যিক বাক্যগঠন
কর্তা+ক্রিয়া+কর্ম              = আমি লেখি ছড়া
ক্রিয়া+কর্তা+কর্ম              = লেখি আমি ছড়া
কর্ম+কর্তা+ক্রিয়া              = ছড়া লেখি আমি
কর্তা, কর্ম বা ক্রিয়া নাও থাকতে পারে    = ছড়া লেখি
কর্তা দুটি অর্থাৎ সম্বন্ধপদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে সম্বন্ধপদ হলে একটি পদের সঙ্গে ‘র বা এর’ যোগ হয়। তদ্ভব শব্দে সম্বন্ধপদ বেশি ব্যবহৃত হয়। যেমন: আম্রকাননে ডাকছে পাখি মধুর কলতানে। আমের বাগানে ডাকছে পাখি মধুর কলতানে। দুটি কর্মের মধ্যে একটি মূখ্য যার সঙ্গে বিভক্তি বসে না। আর গৌণকর্মের সঙ্গে বিভক্তি বসে। যেমন: আমি রহিমকে কবিতাটি দিলাম। দুটি ক্রিয়ার মধ্যে একটি মূখ্য যার সঙ্গে বিভক্তি বসে না। আর গৌণক্রিয়ার সঙ্গে বিভক্তি বসে। যেমন: আমি কবিতা পড়তে পছন্দ করি। বিশেষ বাক্যগঠন (বিশেষ বাক্য বলতে অলংকারপূর্ণ বা চমৎকার কাব্যিক বাক্যকে বোঝায় যা ভুল ব্যবহার নয়)।
বাক্যের প্রথমে সম্প্রসারক+কর্তা+সম্প্রসারক+ক্রিয়াপদ বসবে। যেমন: মনোযোগী কবিরাই রীতিমতো পড়াশুনা করেন। বিশেষণ+সাধারণ বিশেষ্য বসে। যেমন: কানা ছেলের নাম আবার পদ্মলোচন। সর্বনাম বিশেষ্য +নাম বিশেষণ +বিশেষ্য বসে। যেমন: সেই কালো মেয়েটি হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। বিশেষণ পদ সাধারণত পদক্রম অনুসারে বিশেষ্যের আগে বসে। যেমন: খাঁটি গরুর দুধ। ‘কী খাঁটি’ প্রশ্ন করলে পাওয়া যায় গরুর দুধ (সংস্কৃত গোদুগ্ধ)। অনেকেই বর্তমানে এই বাক্যকে ভুল গণ্য করে শুদ্ধ করে লেখেন গরুর খাঁটি দুধ। ইংরেজিতে লেখা হয় Fresh Milk| অর্থৎ খাঁটি দুধ। লেখা হয় না Fresh Cow Milk। সাধারণত গরুর দুধই বিক্রি হয়। তাই গরুর খাঁটি লেখার প্রয়োজন হয় না। নারী বাচক বিশেষ্যের গুণ প্রকাশ করতে বিশেষণের সঙ্গে প্রত্যয় যোগ করতে হয় না। যেমন: সুন্দরী বালিকা>সুন্দর বালিকা, মেয়েটি পাগলি>মেয়েটি পাগল, আসমা অস্থিরা>আসমা অস্থির। ক্রিয়াবিশেষণ ক্রিয়ার আগে বসে। যেমন: তারা ধীরে ধীরে হাঁটে। গুণবাচক, পরিমাণবাচক, সংখ্যাবাচক, সংজ্ঞাবাচক, নির্দেশকবাচক, সম্বন্ধবাচক, প্রশ্নবাচক, পরিচিতিবাচক, বিশেষণের বিশেষণবাচক, ক্রিয়াবিশেষণবাচক, সংকোচবাচক সবধরনের বিশেষণ বিশেষ্যের আগে আলাদা বসে। যেমন: সোনালি ধান, অনেক বই, এক টাকা, প্রধান অতিথি, ঢাকাই মসলিন, এই লোকটি, কত বই, কাঠের পুতুল, বিদ্রোহী কবি নজরুল, সবচে দামি বই, ধীরে ধীরে আসো। কিন্তু সমাসবদ্ধ কিছু বিশেষণ বিশেষ্যের আগে একশব্দ হয়। যেমন: নবজাতক, ঘনসবুজ, খাসকামরা, চিরসবুজ, দীর্ঘশ্বাস, ভগ্নদশা।
যোজক: (কি, কেনো, কিভাবে, কেমন, কবে, কোথায়, কখন) আশ্রিত খণ্ডবাক্যের আগে বসলে আশ্রিত খণ্ডবাক্যটি প্রধান খণ্ডবাক্যের পরে বসে। আশ্রিতবাক্য+যোজক শব্দ+প্রধানবাক্য। যেমন: তিনি জানেন না তিনি আমাকে কখন শেখালেন কবিতা। দুটি শব্দের যোগস্থলে যোজক বসিয়ে, একসঙ্গে অথবা হাইফেন দিয়ে শব্দ জোড়া লাগানো যায়। যেমন: ছেলেটি চোখে ও মুখে কথা বলে। ছেলেটি চোখেমুখে কথা বলে। অথবা ছেলেটি চোখে-মুখে কথা বলে। তবে ‘চোখ-মুখে’ লেখা যাবে না। দুটি শব্দেই বিভক্তি বসে। বিশেষ্যের আগে বসে অর্থাৎ বাক্যের প্রথমে বসে। সম্বন্ধপদের পর ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তি বা কমা বসে। যেমন: ঘরের মানুষ পরের কাছে থাকে। ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। সম্বন্ধপদ+বিশেষণ+বিশেষ্য বসে। যেমন: নাম ধরে সম্বোধন করলে বাক্যের প্রথমে বা শেষে বসে। যেমন: সাবিত ছড়া খুব ভালো লেখে। ছড়া খুব ভালো লেখে সাবিত। যে শব্দে জোর দিতে হয় শুধু সেই শব্দেই ই/ও যোগ করতে হয়। যেমন: তুমিই কাল আসবে। অথবা তুমি কালই আসবে। তুমি কাল আসবেই। আমিও যাব। এমনই কিছু শব্দ আছে গদ্যর পদ্যে ব্যবহৃত হয়—কখনও/এখনও—কখনো/এখনো। শব্দ-শব্দ যুক্ত করতে ‘ও/আর’ বসে। বাক্য-বাক্য যুক্ত করতে ‘এবং/আর’ বসে। অনেকগুলো বিশেষ্য বা বিশেষণ বা ক্রিয়া ব্যবহার করলে শেষটার আগে ‘ও’ বসে অথবা কমা বসে শেষে ইত্যাদি/প্রভৃতি (বস্তু বসে) ও প্রমুখ (ব্যক্তি হলে) বসে।
১. কারকের ব্যবহার ঠিক রাখা                       
বস্তু ও প্রাণিবাচক শব্দে ‘কে’ বসে না। ব্যক্তির নামের সঙ্গেও ‘কে’ বসে না। সাপুড়ে সাপকে খেলায়। (সাপুড়ে সাপ খেলায়)।রবীন্দ্রনাথকে ভালো করে পড়ো (রবীন্দ্রনাথ ভালো করে পড়ো)।
২. বাচ্যের ব্যবহার ঠিক রাখা
বাচ্যের ক্রিয়ার রূপের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ইংরেজি প্যাসিভ ভয়েজে ক্রিয়া সবসময় পাস্ট পারটিসিপল হয়। বাংলায় ক্রিয়ার+ইত/ষ্ট ইত্যাদি যোগ করে ক্রিয়াকে কর্মবাচ্যের ক্রিয়া করা হয়। আপনার কি মনে হয় না, বিধি লঙ্ঘন হয়েছে। সঠিক হবে— আপনার কি মনে হয় না, বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে।
৩. এককথায় প্রকাশের ব্যবহার ঠিক রাখা
এককথায় প্রকাশের ব্যবহার ঠিক রাখা দরকার। যেমন : ‘হাতে কলমে শিক্ষা বা ব্যবহারিক শিক্ষা’ যে কোন একটি বাক্য ব্যবহার করলে বাক্যটি শুদ্ধ হবে। পারলে চারিদিকে প্রদক্ষিণ করো-না হয়ে হবে-পারলে চারিদিকে ঘোর বা পারলে প্রদক্ষিণ কর)।সে হাতে কলমে ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে না হয়ে হবে ‘সে হাতেকলমে শিক্ষা গ্রহণ করেছে বা সে ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে।
৪. প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার ঠিক রাখা
প্রবাদ-প্রবচন হলো অর্থপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বাক্য যা বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। যেমন: স্বল্প (অল্পবিদ্যা) ভয়ংকরী, অভাবে চরিত্র (স্বভাব) নষ্ট, মোল্লার দৌড় ঘর (মসজিদ) পর্যন্ত লেখা যাবে না।
৫. বাগধারার ব্যবহার ঠিক রাখা
বাগধারায় যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয় বা হয়েছে শুধু সেসব শব্দ ব্যবহার করতে হবে। সেটি পরিবর্তন করে বাক্য তৈরি করলে বাক্যটি হবে অশুদ্ধ। যেমন: তারা গরিবের পাকা ধানে আগুন দিয়েছেন। (তারা গরিবের পাকা ধানে মই দিয়েছেন)।
অরণ্যে কান্না (রোদন), চিনির গরু (বলদ), আলু (পটল) তোলা, ভিজে ইঁদুর (বেড়াল) লেখা যাবে না। বাগধারার নিজস্ব গঠন যেমন ঐতিহ্যগত তেমনি এর অর্থও সুনির্ধারিত তাই এর কোনটি পরিবর্তন করে বাক্যে ব্যবহার করলে বাক্য তার যোগ্যতা হারায়।
৬.রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা বজায় রাখা
বাক্যে সবসময় প্রকৃতি ও প্রত্যয় নিষ্পন্ন শব্দের অর্থ ব্যবহৃত না হয়ে রীতিসিদ্ধ অর্থ ব্যবহৃত হয়। তাই উচিৎ শব্দের অর্থ ঠিক রেখে বাক্য গঠন করা। যেমন: হাত+ই=হাতি না হয়ে হবে ‘হাত’ আবার পানজাব+ই=পানজাব দেশের লোক না হয়ে হেবে ‘লম্বা জামা’ বিশেষ।
৭. প্রাঞ্জলতা (সহজবোধ্য বাক্য) বজায় রাখা
তুমি যাহা লিখিবে লোকে পড়িবামাত্র যেন বুঝিতে পারে। যাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা বৃথা। ‘মনীক্ষোভাকুল কুবলয়’ কেহ কি সহজে বুঝিবে আর যদি বলি ‘মাছের তাড়নে যে পদ্ম কাঁপিতেছে’ তবে কেনা বুঝিবে? (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
৮. অর্থব্যক্তি (উপযুক্ত শব্দ নিবার্চন এবং ব্যবহার) বজায় রাখা
‘যে কথাটিতে কাজ হইবে, সেই কথাটি ব্যবহার করিবে’ (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। অর্থাৎ যে শব্দ দিয়ে মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় সেই শব্দটি গ্রহণ করা এবং ওটা যদি ভাব ও বাক্যের উপযুক্ত শব্দ হয় তাহলে সেটি নিবার্চন করা।
৯. গুরুচণ্ডালী মুক্ত রাখা (বড় জাত ও ছোট জাত)
সংস্কৃতি ও দেশি শব্দের (ক্রিয়াশব্দ) সংমিশ্রণে তৈরি বাক্য, বাক্যের যোগ্যতা হারায়। কিন্তু জীবনানন্দ ও জসীমউদদীন ক্রিয়ার ব্যবহার অনেক করেছেন। ‘গরুর যুথ যেন মরুভূমির ঢেউ।’ এখানে ‘পাল’ না লিখে ‘যুথ’ লিখলে বাক্যের যোগ্যতা হারায়। ‘পয়লা বৈশাখ’ না হয়ে ‘পহেলা বৈশাখ’ বা ‘পয়লা বোশেখ’ হবে।
১০. যতির ব্যবহার ঠিক রাখা
আবেগশব্দের পরে আবেগচিহ্ন বসে শেষে দাঁড়ি বসে। বাক্যে আবেগ, বিস্ময়, ঘৃণা ইত্যাদি উল্লেখ থাকলে আবেগচিহ্ন না বসে দাঁড়ি বসে।
অনেকগুলো বিশেষ্য বা সর্বনাম বা বিশেষণ বা ক্রিয়া থাকলে সবগুলোর আগে কমা বসে আর শেষটির আগে ‘ও’ বসে অথবা ‘ও’ না বসে শেষে ‘ইত্যাদি/প্রভৃতি/প্রমূখ’ বসে। একই বাক্যে ‘ও’ আর ‘ইত্যাদি’ বসে না। অসমাপিকা ক্রিয়ার (এ-বিভক্তিযুক্ত ক্রিয়া) পরে কমা বসে না। একক বা জোড়া যোজক বাক্যে কমা বা সেমিকোলন বসে না। কবিতার লাইনে যত্রতত্র যতির ব্যবহার কাম্য নয়। আবেগশব্দ বাক্যের শুরুতে বসে। যেমন: বাহ! কী সুন্দর। আ!, অ!, উহ! বাহ! এদের পরে কমা না বসে আবেগচিহ্ন বসে। আবেগচিহ্নের পরে দাঁড়ি বসে। বাক্যে আবেগ, বিস্ময়, ঘৃণা ইত্যাদি উল্লেখ থাকলে আবেগচিহ্ন না বসে দাঁড়ি বসে। যেমন: ‘বাহ! পাখিটি কত সুন্দর’ ‘বাহ, পাখিটি সুন্দর!’ হবে না। আবার ‘বাহ পাখিটি কত সুন্দর!’ হবে না। সে আবেগের কথা বলল! (এখানে আবেগচিহ্ন না বসে দাঁড়ি বসে)। একই সঙ্গে ‘ও’র ‘ইত্যাদি’ বসে না। তারিখের বেলায় সংখ্যা পাশাপাশি বসলে কমা বসে কিন্তু তারিখের মাঝে মাসের নাম থাকলে কমা বসে না। যেমন: ১২, ১২, ২০১২/১২ এপ্রিল ২০১৩। উক্তিজাতীয় বাক্যে বলল—এরপরে কমা বা ড্যাশ (হাইফেন নয়) বা কোলন বসে। তবে বলল— এরপরে আরেকটি কমা বসালে এরপরে বললে-এরপরে ড্যাশ ব্যবহার করা উচিত। কমার পরে এক বা জোড় উর্ধ্বকমা ব্যবহার করার দরকার নাই। যেমন: উপ-সচিব না হয়ে হবে উপসচিব। দুটি বাক্যকে যুক্ত বা বিযুক্ত করতে এমন ‘এবং, তাই /সেহেতু /কারণে/ফলে, কিন্তু/তবু /তবুও, যদিও তাহলে/তবে, যদিও— তথাপি, এ—যে— সেটি, এ—সেটি, যখন—তখন, শুধু—ও’ মাঝে বসলে এদের আগে বা পরে কমা বসে না। এরা পরস্পরের সঙ্গে মিল রেখে বাক্যে বসে। জটিল বাক্যে কর্তার পরে জটিলচিহ্ন (যা— তা, যত— তত) বসে। এদের পরে কমা বসে না। যেমন: যে যত পড়ালেখা করে সে তত ভালো করে।

0 comments:

Post a Comment