রূপতত্ত্ব - শব্দগঠনের উপায় (উপসর্গ)
বিভিন্ন উপায়ে শব্দ গঠন করা যায়। যেমন : কার যোগে-ম+আ=মা, ফলা যোগে-রত্ন/বিশ্ব/পদ্ম/পদ্য/ক্রয় /ধর্ম/ক্লান্ত, ব্যঞ্জন যোগে-পক্ক ইত্যাদি। আবার গঠনের দিক দিয়ে শব্দ দুই প্রকার। যেমন:
১. মৌলিকশব্দ: যেসব শব্দ সন্ধি, সমাস, উপসর্গ, প্রত্যয়, বিভক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে আলাদা করা যায় না তাদের মৌলিকশব্দ বলে। যেমন: বই, কলম, হাত, পা, লাল ইত্যাদি।
২. সাধিতশব্দ: যেসব শব্দ সন্ধি, সমাস, উপসর্গ, প্রত্যয়, বিভক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে আলাদা করা যায় তাদের সাধিত শব্দ বলে। যেমন: গাছে (গাছ+এ), বোকামি (বোকা+আমি), ডুবুরি (ডুব+ উরি), বিদ্যালয় (বিদ্যা+আলয়), রবীন্দ্র (রবি+ইন্দ্র)। ছেলে ও মেয়ে (ছেলে-মেয়ে), কুসুমের মতো কোমল (কুসুমকোমল), মনরূপ মাঝি (মনমাঝি), মধুর>মাধুর্য, দীন>দৈন্য, ছাইদানি, হেডমৌলবি ইত্যাদি।
উপসর্গ
যেসব অর্থহীন বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দের আগে যুক্ত হয়ে নতুন নতুন শব্দ গঠন করতে সাহায্য করে তাদের উপসর্গ বলে। অথবা উপসর্গ হলো অর্থহীন বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি যারা শব্দের আগে বসে নতুন শব্দ গঠন করে। যেমন: আ—আগাছা, পরা—পরাজয়। উপসর্গ শব্দের আগে বসে শব্দটিকে (বিশেষ্য বা ক্রিয়া) হাবোধক বা নাবোধক দুটি অর্থেও প্রকাশ পেতে পারে। শব্দের আগে ‘আ’ বসলে হবে উপসর্গ আর ‘আ’ শেষে বসলে হবে প্রত্যয়। যেমন: আগাছা (আ+গাছ+আ), আকাঁড়া, আধোয়া, আকাঠা। তবে সংস্কৃত শব্দের শেষে ‘আ’ যোগ হয় না। যেমন: আকণ্ঠ, আমরণ, আসমুদ্র, আরক্ত, আভাস, আদান, আগমন ইত্যাদি। আবার অ/আ/অপ উপসর্গ আছে যারা নাবোধক কিন্তু শব্দের আগে বসে নাবোধ প্রকাশ করে না। যেমন: অপর্যাপ্ত, অপ্রচুর, অমূল্য, অপরূপ, আকণ্ঠ ইত্যাদি।
বলা হয় উপসর্গের অর্থবাচকতা অর্থাৎ নিজস্ব কোন অর্থ নাই কিন্তু অর্থদ্যোতকতা অর্থাৎ নতুন শব্দ গঠন করার ক্ষমতা আছে। উপসর্গের নিজস্ব কোন অর্থ নাই তবে কয়েকটি উপসর্গের অর্থ আছে। যেমন: অতি, অনু, ইতি, কু, সু, প্রতি, সম, রাম, কম, দর, খোশ, না, ফুল, হাফ, সাব, হেড ইত্যাদি। আবার ‘আ, নি, বি, সু’ সংস্কৃত ও বাংলা উভয় উপসর্গেই আছে।
ব্যাকরণবিদগণ উপসর্গ সম্পর্কে বলেন
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন: সংস্কৃতে কতকগুলি অব্যয় আছে যেগুলি ধাতুর পূর্বে যুক্ত হইয়া ধাতুর অর্থে পরিবর্তন ঘটিয়ে ধাতুর নতুন অর্থের সৃষ্টি করে। সংস্কৃত ব্যাকরণে ধাতুর পূর্বে প্রযুক্ত এইরূপ অব্যয়কে বলা হইয়াছে উপসর্গ।
ড.রামেশ্বর : শব্দ বা ধাতুর আদিতে যা যোগ হয় তাকে বলে উপসর্গ।
অশোক মুখোপাধ্যায়: কিছু অব্যয় আছে যারা ধাতু বা শব্দের আগে যুক্ত হয়ে তাদের অর্থ বদল করে দেয়। এদেরই বলা হয় উপসর্গ।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক: যে সকল অব্যয় শব্দ কৃদন্ত বা নামপদের পূর্বে বসিয়া শব্দগুলির অর্থের সংকোচন সম্প্রসারণ বা অন্য কোন পরিবর্তন সাধন করে, ঐ সকল অব্যয় শব্দকে বাংলা ভাষায় উপসর্গ বলে।
উপসর্গের বৈশিষ্ট্য বা কাজ
১. কিছু বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি যারা ধাতু বা নামশব্দের আগে বসে
২. যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নাই
৩. যারা অর্থের পরিবর্তন করে
৪. যারা অর্থের সম্প্রসারণ ও সংকোচন করে
৫. যারা নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরি করে বা অর্থের পূর্ণতা দেয়
উপসর্গের প্রকরণ
সংস্কৃত উপসর্গ (২০টি)
সংস্কৃত উপসর্গ +সংস্কৃত শব্দ = সংস্কৃত শব্দ। যেমন: অতি, অনু, অধি, অপ, অপি, অব, অভি, আ, উৎ, উপ, নি, নির, দূর, পরা, পরি, প্র, প্রতি, বি, সু, সম।
২০টি সংস্কৃত উপসর্গযোগে নতুন সংস্কৃত শব্দ গঠন যায়। যেমন:
উপসর্গ, অর্থ ও গঠিত নতুন শব্দ
১. অতি
বেশি, অস্বাভাবিক, পার হওয়া : অতিবৃষ্টি, অতিচালাক, অতিভক্তি, অতিক্রম
২. অনু
পেছনে, তুল্য, বারবার, সাথে : অনুরাগ, অনুবাদ, অনুসরণ, অনুশীলন
৩. অধি
আধিপত্য, উপরি : অধিকার, অধিবাসী, অধিষ্ঠান, অধিকার, অধিবাস
৪. অপ
বিপরীত, খারাপ, স্থানান্তর, খুব : অপমান, অপচয়, অপহরণ, অপরূপ
৫. অপি
যথা, বেশি : অপিনিহিতি, অপিচ
৬. অব
হীনতা, সাফল্য, নামা, স্বল্পতা,
সম্যকভাবে : অবজ্ঞা, অবদান, অবতরণ
৭. অভি
সম্যক, গমন, দিক : অভিব্যক্তি, অভিজ্ঞ, অভিভূত, অভিযান
৮. আ
পর্যন্ত , সামান্য, বিপরীত : আমরণ, আসুমদ্র, আভাস, আদান, আগমন
৯. উৎ
ঊর্ধ্বমুখিতা, প্রস্তুতি, অপকর্ষ : উন্নতি, উত্তোলন, উৎফুল্ল, উৎপাদন, উচ্চারণ
১০. উপ
সামীপ্য, সদৃশ, ক্ষুদ্র, বিশেষ : উপকূল, উপবন, উপগ্রহ, উপভোগ, উপহার
১১. দুর/দু/দুঃ
মন্দ, কষ্টসাধ : দুঃসাহস, দুঃশাসন, দুঃসপ্ন, দুঃসাধ্য, দুঃসংবাদ,
দুর-এর জন্য র বা রেফ হয় দুর্গম, দুর্নাম, দুর্লভ
আর দূর অর্থ দূরে, এটি উপসর্গ নয়
১২. নি /নিঃ
নিষেধ, নিশ্চয়, আতিশায্য, অভাব : নিবৃত্তি, নিবারণ, নিখুঁত, নিকৃষ্ট, নিঃশ্বাস, নিঃসন্তান, নিঃস্বার্থ
১৩. নির
অভাব, নিশ্চয়, বাহির বা রেফ হবে : নিরক্ষর, নির্ণয়, নির্ভর, নির্মাণ
১৪. পরা
আতিশয্য, বিপরীত : পরায়ণ, পরাশক্ত, পরাজয়, পরাধীন, পরাহত, পরাভব
১৫. পরি
বিশেষ, শেষ, সম্যক, চারদিক : পরিপূর্ণ, পরিধান, পরিশ্রম, পরিকল্পনা
১৬. প্র
প্রকৃষ্ট, খ্যাতি, আধিক্য, গতি : প্রজ্ঞা, প্রবল, প্রসার, প্রচার, প্রবেশ, প্রস্থান
১৭. প্রতি
সদৃশ, বিরোধ, বারবার : প্রতিধ্বনি, প্রতিবাদ, প্রতিদ্বন্দ্বি, প্রতিদিন, প্রতিদান
১৮. বি
বিশেষ, অভাব, গতি, অপ্রকৃতস্থ : বিশুদ্ধ, বিজ্ঞান, বিবর্ণ, বিশৃঙ্খল, বিফল
১৯. সু
ভাল, সহজ, আতিশয্য : সুকণ্ঠ, সুনীল, সুগম, সুজন, সুলভ, সুনজর
২০. সম
সম্মুখ, সামনে, খবর, সমান : সম্পূর্ণ, সম্মুখ, সংবাদ, সমাদর, সম্মান
দেশি উপসর্গ (২১টি)
দেশি উপসর্গ+দেশি শব্দ = দেশি শব্দ। যেমন: অ, অজ, অঘা, অনা, আ, আড়, আন, আব, ইতি, উন, কদ, কু, নি, পাতি, বি, ভর, রাম, স, সা, সু, হা। ২১টি দেশি উপসর্গযোগে নতুন দেশিশব্দ গঠন যায়। যেমন:
উপসর্গ, অর্থ ও গঠিত নতুন শব্দ
১. অ
মন্দ, না, পরিমাণ : অকেজো, অচেনা, অচিন, অজানা, অঢেল, অফুরন্ত
২. অঘা
বোকা : অঘারাম, অঘাচণ্ডী, অঘাগুশাই
৩. অজ
মন্দ : অজগাঁ, অজপাড়াগাঁ, অজপুকুর
৪. অনা
মন্দ : অনাবৃষ্টি, অনাচার, অনামুখো
৫. আ
অভাব, বাজে, অশুভ : আধয়া, আলুনি, আগাছা, আকাল, আকথা
৬. আড়
বাঁকা, অর্ধেক, প্রায় : আড়চোখে, আড়ভাঙা, আড়কোল
৭. আন
না, কাঁচা, চঞ্চল : আনাড়ি, আনকোরা, আনচান, আনমনা
৮. আব
অস্পষ্ট : আবছায়া, আবডাল
৯. ইতি
আগে, পুরানো : ইতঃপূর্বে, ইতোমধ্যে, ইতিকথা, ইতিহাস
১০. উন কম : উনপাঁজুরে, উনোভাত, উনোন, উনচল্লিশ, উনবিংশ
১১. কদ
খারাপ, ছোট : কদাকার, কদবেল
১২. কু
নিন্দনীয়, মন্দ : কুকাজ, কুকথা, কুনজর, কুচরিত্র
১৩. নি
নাই : নিখুঁত, নিখোঁজ, নিলাজ, নির্বোধ, নিরেট
১৪. পাতি
ছোট, ক্ষুদ্র : পাতিহাঁস, পাতিলেবু, পাতিনেতা
১৫. বি
না, নিন্দা, ভিন্ন : বিকল, বিস্বাদ, বিফল
১৬. ভর
পরিপূর্ণ : ভরপেট, ভরদুপুর, ভরপুর, ভররোদ, ভররাত
১৭.রাম
বড়, ছোট, উৎস: রামছাগল, রামধনু, রামবাগুন, রামকলা, রামরাজা
১৮. স
সাথে, উপযুক্ত : সরব, সজোর, সকাল, সক্ষম, সঠিক, সবল
১৯. সা
অবস্থা, উৎকৃষ্ট : সাবালক, সাজিয়া, সাজোয়ান
২০. সু
ভাল, সৎ : সুকাজ, সুনজর, সুচরিত্র, সুখবর, সুদিন, সুনাম
২১. হা
অভাব : হাভাতে, হাহুতাশ, হাপিত্যেশ
বিদেশি উপসর্গ (২১টি)
বিদেশি উপসর্গ +বিদেশি শব্দ =বিদেশি শব্দ। যেমন: ফারসি-কম, কার, খোশ, দর, না, নিম, ফি, ব, বে, বদ, বর। আরবি-আম, খাস, গর, বাজে, লা। ইংরেজি-ফুল, সাব, হাফ, হেড। হিন্দি-হর।
২১টি বিদেশি উপসর্গযোগে নতুন বিদেশি শব্দ গঠন যায়। যেমন:
উপসর্গ, অর্থ ও গঠিত নতুন শব্দ
আরবি
১. আম
সাধারণ : আমজনতা, আমদরবার, আমমোক্তার, আমকথা
২. খয়ের
তোষামদ : খয়ের খাঁ
৩. খাস
বিশেষ : খাসমেহমান, খাসমহল, খাসমসজিদ, খাসকথা
৪. গর
অভাব : গরমিল, গরহাজির, গররাজি
৫. বাজে
খারাপ : বাজেকাজ, বাজেকথা, বাজেখরচ
৬. লা
না : লাজওয়াব, লাপাত্তা, লাশরিক
ফারসি
৭. কম
স্বল্প : কমজোর, কমপোখত
৮. কার
কাজ : কারখানা, কারসাজি, কারচুপি, কারবার
৯. দর
মধ্যস্থ অধীন : দরপত্তনি, দরখাস্ত , দরদাম
১০. না
না : নারাজ, নাচার, নামঞ্জুর, নাখোশ, নালায়েক
১১. খোশ
ভাল : খোশমেজাজ, খোশখবর, খোশগল্প, খোশআমদদ
১২. নিম
অল্প : নিমরাজি, নিমমোল্লা, নিমকথা
১৩. ফি
প্রতি : ফিরোজ, ফিহপ্তা, ফিদিন, ফিমাস, ফিবছর, ফিসন, ফিসাল
১৪. ব
সাথে : বনাম, বকলম, বমাল
১৫. বর
বাইরে, মাঝে : বরখাস্ত , বরদাস্ত , বরখেলাপ, বরবাদ
১৬. বে
না : বেআদব, বেআক্কল, বেনামি, বেকারম, বেহায়া, বেতার
১৭. বদ
খারাপ/মন্দ : বদমেজাজ, বদরাগি, বজ্জাদ, বদহজম, বদমাশ
ইংরেজি
১৮. ফুল
সম্পূর্ণ : ফুলহাতা, ফুলশার্ট, ফুলপ্যান্ট, ফুলবাবু, ফুলমোল্লা
১৯. হাফ
অর্ধেক : হাফহাতা, হাফশার্ট, হাফপ্যান্ট, হাফস্কুল, হাফটিকিট
২০. সাব
অধীন : সাবঅফিস, সাবজজ, সাবইন্সপেক্টর
২১. হেড
প্রধান : হেডঅফিস, হেডমাস্টার, হেডমৌলবি
উপসর্গের বৈশিষ্ট্য অথবা উপসর্গের অর্থবাচকতার অর্থদ্যোতকতা
হার শব্দের আগে যথাক্রমে আ, উ, উপ, প্র, পরি, বি, সম (সং) ইত্যাদি উপসর্গ যোগ করে ভিন্নভিন্ন অর্থপূর্ণ শব্দ গঠন করা যায়। নমুনা সরূপ দেখানো যায়-আহার (খাওয়া), উদ্ধার (রক্ষা), উপহার (গিফ্ট), প্রহার (মারা), পরিহার (পরিত্যাগ), বিহার (ভ্রমণ), সংহার (হত্যা) ইত্যাদি। তাহলে উপরের নমুনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, উপসর্গের নিজস্ব কোন অর্থ নাই কিন্তু তাদের ক্রিয়া বা নামশব্দের আগে বসে নতুনশব্দ গঠন শব্দের অর্থ পরিবর্তন, সম্প্রসারণ ও সংকোচন করা এবং অর্থের পূর্ণতা দান করার ক্ষমতা আছে। এইজন্য বলা হয়, উপসর্গের অর্থবাচকতা অর্থাৎ নিজস্ব কোন অর্থ নাই কিন্তু অর্থদ্যোতকতা বা নতুনশব্দ গঠন করার ক্ষমতা আছে।
0 comments:
Post a Comment