রূপতত্ত্ব- দ্বিরুক্তি
শব্দদ্বিত্ব দিয়ে আমরা সম্ভাব্য, বহুবচন ও অনুকার বুঝাতে ব্যবহার করি। বিশেষ অর্থ প্রকাশের জন্য যেসব শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয় তাদের দ্বিরুক্তি বা দ্বৈতশব্দ বা শব্দদ্বিত্ব বলে। যেমন: আমার জ্বর হয়েছে এবং জ্বর জ্বর লাগছে এক অর্থ নয়। জ্বর থেকে জ্বর জ্বর, বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে থাকে। কথাকে সুন্দর ও ছন্দময় করতে, বাক্যের বিশেষ অর্থ দিতে শব্দদ্বিত্বের বিশেষ দরকার। অনুভূতির ধ্বনির সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি শব্দ দিয়ে একটি বিশেষ অর্থবোধক শব্দ বানানো যায়। আবার ধ্বনাত্বকজাতীয় একই শব্দ দুবার বসিয়ে বিশেষ অর্থ প্রকাশের জন্য যেসব শব্দ দুইবার ব্যবহৃত হয় তাদের দ্বিত্বশব্দ বলে। শব্দদ্বিত্ব দিয়ে শব্দ গঠন করা যায়। শব্দদ্বিত্বকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:
১. শব্দদ্বিত্ব : বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে শব্দে দুবার ব্যবহৃত হয়। যেমন: ভাল ভাল ফল, ছোট ছোট ঘর, বিন্দু বিন্দু জল, লালনপালন, বকাঝকা, লেনদেন, ধনী গরিব।
২. পদদ্বিত্ব : বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে পদ দুবার ব্যবহৃত হয়। যেমন: বর্তমানে ঘরে ঘরে শিক্ষিত। মনে মনে বলি, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।
৩. অনুকার দ্বিত্ব : যেসব অনুভবপ্রধান শব্দ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে দুবার ব্যবহৃত হয়। যেমন: শাঁইশাঁই, পনপন, ঝনঝন, মিউমিউ, ঝিকঝিক, টপাটপ, বকবকানি।
দ্বিত্বশব্দ গঠনপদ্ধতি
বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে দ্বিত্ব শব্দ গঠন করা যায়। যেমন:
১. বিশেষ্য+বিশেষ্য = দিন দিন, বাড়ি বাড়ি
২. বিশেষণ+বিশেষণ = ছোট ছোট, ভালো ভালো
৩. সর্বনাম + সর্বনাম = কে কে, সে সে
৪. অসমাপিকাক্রিয়া + অসমাপিকাক্রিয়া = হাসতে হাসতে, যেতে যেতে, হেসে হেসে
৫. যোজক + যোজক = ছি ছি, টন টন, টাপুর টুপুর
দ্বিত্বশব্দের নিয়ম
১. বিশেষ্য শব্দের দ্বিত্ব: এরা সমার্থক, প্রায় সমার্থক ব্যতিহার, অনুকার বা বিপরীত হতে পারে। যেমন: কবি কবি, দিন দিন, বাড়ি বাড়ি, লোকে লোকে, দ্বারে দ্বারে, সঙ্গি-সাথি, রাশিরাশি, ছোট বড়, সুখদুখ, আলো-আঁধার, ওঠা-বসা, আকাশে-বাতাসে, দলে-বলে, থেকে থেকে, হাড়ে হাড়ে, ফাঁকে ফাঁকে, পথে পথে, পাতায় পাতায়, সময় সময়, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, দিনে দিনে, পিছে পিছে, পাশে পাশে, উপরে উপরে, পাছে পাছে, সারিসারি, ধামাধামা, জ্বরজ্বর, মাথামুণ্ডু, বাড়িঘর, কলকারখানা, ধনদৌলত, উল্টাপাল্টা, হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব, হেসেখেলে, নেচেগেয়ে, পড়েশুনে, বারবার, আগাগোড়া, রেগেমেগে, ধনী গরিব, গল্পস্বল্প, রকমসকম, দেনাপাওনা, টাকাপয়সা, ভাতটাত, চালচলন, ডালভাত, তালাচাবি, পথঘাট, বনজঙ্গল, অলিগলি, জারিজুরি, ভয়েভয়ে, হাটেহাটে, হাতেনাতে, চোখেচোখে, মুখেমুখে, গল্পস্বল্প ইত্যাদি।
২. বিশেষ্য/বিশেষণ শব্দে দ্বিত্ব: অনেক সময় কবিগণ দুটি বিশেষ্য ব্যবহার করেন যা ত্রুটিপূর্ণ বলে অনেকেই সমালোচনা করেন। কিন্তু কবি যদি তাঁর ব্যবহৃত দুটি শব্দের প্রথম বিশেষ্য দিয়ে বিশেষণ এবং দ্বিতীয় বিশেষ্য দিয়ে বিশেষ্য বুঝাতে পারেন তাহলে ব্যবহার ত্রটিপূর্ণ হবে না। যেমন: তনুর দেহ একই অর্থ অর্থাৎ শরীর অর্থ বহন করে তবে এখানে তনু— নমুনীয়/কমনীয় /সরু অর্থ প্রকাশ করছে। শুভ্রশাদা। শুভ্রর শাদা একই অর্থ বহন করে তবে এখানে শুভ্র— ধবধবে/অতিশয় শাদা/উজ্জ্বল অর্থ প্রকাশ করছে। কিন্তু অশ্রুজল দিয়ে তেমন বোঝায় না। অশ্রু অর্থ চোখের জল কিন্তু অশ্রু দিয়ে জলের কোন বিশেষণ প্রকাশ করছে না।
৩. সর্বনাম শব্দে দ্বিত্ব: যারা যারা, কে কে, সে সে, কেউ কেউ ইত্যাদি।
৪. যোজক অনুকার বা ধ্বনাত্মক শব্দে দ্বিত্ব: এসব নিরর্থক শব্দ অর্থবোধক হয়ে যায় ব্যবহারের পর। যেসব যোজক বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতে দুবার ব্যবহৃত হয়ে ধ্বনি সৃষ্টি করে তারাই অনুকার যোজক । বকবকানি। আবার এসব শব্দের মাঝে আ-কারের আগমন ঘটে। শূন্যতা, রং বা বর্ণের স্বরূপ, শরীরের অনুভূতি, গতি, দ্বীপ্তি ইত্যাদি বুঝাতে এসব শব্দ দুবার ব্যবহার করা হয়। এগুলো আবার নিচের ভিন্নভিন্ন অর্থে প্রকাশ পেতে পারে। যেমন: শরীরে অনুভূতি: যখন যখন, সহচর-অনুচর, বন্ধু-বান্ধব, হায় হায়, ছি ছি, বারবার ইত্যাদি। কুহুকুহু, কা কা, ঠাঠা, কুটকুট, কিটকিট, কুচকুচ, কুচকুচে, ক্যাঁচক্যাঁচ, কিচিরমিচির, খলখল, খচখচ, খিলখিল, খিটমিট, খপখপ, গমগম, গরগর, ঘরঘর, ঘুটঘুটে, গাপুসগুপুস, টনটন, ঠনঠন, ডংডং, ডিমডিম, ঢংঢং, টাপুরটুপুর, টংটং, টুকটুক, টুকটুকে, মিটিরমিটির, টকটক, চটচট, চিকচিক, ছমছম, ছলছল, ঝিঝি, ঝনঝন, ঝিকঝিক, ঝিরঝির, ফুরফুরে, পনপন, মিউমিউ, মচমচ, মটমট, মড়মড়, মিটমিট, মিনমিন, পিটপিট, থমথম, ধবধব, সিরসির, ফড়ফড়, ভেউভেউ, ভড়ভড়, বকরবকর, বড়বড়, খনখন, পড়পড়, চকচক, ফটফট, বজরবজর, বিড়বিড়, ব্যাজব্যাজ, ফকফক, খকখক, বকবক, বনবন, ভনভন, ভ্যানভ্যান, রিমঝিম, রুনুঝুনু, রিনিঝিনি, শাঁইশাঁই, হনহন।
আবার মাঝে স্বরকার যুক্ত হয়: ধপধপ>ধপাধপ, টপাটপ, গপাগপ, সপাসপ, পটাপট, ফটাফট, খটাখট, ছলাছল, ঝটাঝট, বকবকানি, ছটফটানি, ঝমঝমানি, চুপচাপ, ছলছলিয়ে, কলকলিয়ে, ঝনঝনিয়ে, খিটমিটিয়ে, খপখপাৎ/খপখপিয়ে, চটচটিয়ে, কুলুকুল, খচাখচ, ছমছম, চটপটে, চিনচিন, কটকট, কুটকুট, কনকন, চটপটে ইত্যাদি। আঁকুপাঁকু, হীনহীন, ছটফট, ধুকধুক, টনটন, ম্যাজম্যাজ, পিনপিন রিরি, সুড়সুড় ইত্যাদি।
গতি: খটখট, গটগট, ঘটঘট, থপথপ, ধপধপ, ধপাসধপাস, শাঁশাঁ, হনহন, পনপন, ভনভন, ফিসফিস, পতপত, ফতফত, দুমদুম, ধুমধুম, ধামধাম, দ্রুমদ্রাম, ঠাসঠাস, ঝপাতঝপাত, ঢকঢক, দুপদুপ, ফোঁসফোঁস ইত্যাদি। শূন্যতা: ধুধু, খাঁখাঁ, থইথই, ঝাঁঝাঁ, হাঁহাঁ ইত্যাদি। রঙ/বর্ণ: ফুটফুটে, কুচকুচে, ধবধবে, দগদগে, রগরগে, চটচটে। দীপ্তি: জ্বলজ্বল, ঝকঝক, ঝলমল, ঝিলিমিলি, ঝিকমিক।
৫. সমাপিকাক্রিয়ার দ্বিত্ব: আসা-যাওয়া, লেনদেন, বকাঝকা, খেলাধুলা, লালন-পালন, খোঁজ-খবর, যায়যায়।
৬. অসমাপিকাক্রিয়ার দ্বিত্ব: হাসতে হাসতে, যেতে যতে, হেসেহেসে, দেখতে দেখতে, দেখেদেখে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, ডেকেডেকে, মারামারি, হাতাহাতি, জেদাজেদি, ছটফট, নিশপিশ, হেঁটেহেঁটে, খেয়েখেয়ে, নেচেনেচে, কেঁশেকেঁশে, ভেসেভেসে।
৭. ক্রিয়াবিশেষণের দ্বিত্ব : ধীরে ধীরে, ফিরে ফিরে, আস্তে আস্তে ইত্যাদি।
0 comments:
Post a Comment