রূপতত্ত্ব- শব্দভাণ্ডার ও বাংলাশব্দের উৎস
অর্থপূর্ণ ধ্বনি সমষ্টিই শব্দ। শব্দ আমাদের অতীতের কথা শোনায়। একদিন যা ছিল মানুষের মনে তা মুখে উচ্চারিত হয়ে শব্দরূপে ধরা দেয়। এক একটি নির্দিষ্ট সমাজ বলতে পারে কোন শব্দের কী মানে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন অভিজ্ঞতালব্ধ মৌলিক শব্দ, প্রত্যয়, উপসর্গ যোগে এবং সমাসের সাহায্যে নতুন নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরি করে যাচ্ছে। এক সময় যে শব্দ ছিল সবচেয় জনপ্রিয় কালের বিবর্তনে সে শব্দ হয়তো চির কালের জন্য হারিয়ে গেছে। আবার নতুন শব্দ কবি-সাহিত্যিক-গবেষকদের কল্যাণে নবরূপ পেয়েছে। এভাবেই গ্রহণ-বর্জনের মধ্যেদিয়ে লক্ষাধিক শব্দ বাংলা ভাষার অভিধানে স্থান করে নিয়েছে। শব্দই ভাষাকে গতিময় করেছে তাই শব্দকে বলা হয় শব্দব্রহ্ম। ভাষার ক্ষুদ্রতম অংশ হলো ধ্বনি যা মুখের মাধ্যমে প্রকাশিত অর্থবহ আওয়াজ। এই অর্থবহ আওয়াজের লিখিতরূপ হলো বর্ণ। আর এই অর্থবহ বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে শব্দ বলে। এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থপূর্ণ মিলনই শব্দ।
বাংলা ভাষার অভিধানে যেসব শব্দ আছে অথবা যেসব শব্দ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে, মুখে ব্যবহার করে বা লিখে মনের ভাব প্রকাশ করে সেসব সঞ্চিত শব্দই শব্দভাণ্ডার নামে পরিচিত। যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যত উন্নত সেই ভাষা তত সমৃদ্ধ। বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে আমাদের উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া শব্দ। যেগুলো অনেকটা পুরোনো শব্দ। ঋণকরা শব্দ এবং বিভিন্ন নিয়মের মাধ্যমে তৈরিকৃত শব্দ। দুটি উপায়ে শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করা সম্ভব। (১) শব্দের উৎপত্তি বা উৎস অনুসারে (২) শব্দের গঠন অনুসারে।
‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ বইতে বাংলা শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে বলা হয়েছে, কালে কালে বাংলা ভাষা নানা ভাষার সংস্পর্শে এসেছে। যে-সব ভাষার শব্দকে গ্রহণ করে এ ভাষা ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়েছে। এর শব্দভাণ্ডারও বেড়েছে। এদেশে মুসলিম শাসনামলে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। পরে ইংরেজ শাসনামলে এ ভাষায় গৃহীত হয়েছে অনেক ইংরেজি শব্দ। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার কিছু কিছু শব্দ স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। বাংলা কবিতায় অনুবাদের সূত্রেসংস্কৃতের ঋণ প্রথম থেকেই বিপুল ছিল, পরে উনিশ শতকের গদ্যে তা আরও প্রবল হয়।এছাড়া নানা ভাষা থেকে নানা সূত্রে কিছু কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশাধিকার পেয়েছে। বর্তমানে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার সূত্রে এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে অনেক নতুন নতুন শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে। এর ফলে ভাব প্রকাশের ক্ষমতা ক্রমেই বাড়ছে এবং তা অধিকতর সমৃদ্ধ হচ্ছে।
অস্ট্রিক ভাষা, দ্রাবিড় ভাষা, আর্য অর্থাৎ বৈদিক ভাষা, সংস্কৃত ভাষা (বৈদিক ভাষার সংস্কার), পালি ভাষা, প্রাকৃত ভাষা, অপভ্রংশ, আঞ্চলিক, প্রাদেশিক, বিদেশি ইত্যাদি ভাষার মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় এসেছে। উৎস অনুসারে শব্দভাণ্ডারকে কয়েকভাবে বৃদ্ধি করা যায়। যেমন:
১. সংস্কৃত শব্দ: যেসব শব্দ সংস্কৃতভাষা থেকে হুবহু বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের সংস্কৃত শব্দ বলে। এর বানান কোন পরিবর্তন হবে না। যেমন: গাত্র, কৃষ্ণ, মস্তক, হস্ত, কর্ণ, বৃক্ষ, মৎস্য, স্বর্ণ ইত্যাদি।
২. খণ্ডসংস্কৃত শব্দ: যেসব শব্দ সংস্কৃতভাষা থেকে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের খণ্ডসংস্কৃত শব্দ বলে। এর বানান সংস্কৃত শব্দ থেকে পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: গতর, কেষ্ট, গিন্নি, মাথা, হাত, কান, গাছ, মাছ, সোনা, উঠে, করছি, করছিলাম ইত্যাদি। আরো কিছু নমুনা:
সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত সংস্কৃত খণ্ডসংস্কৃত
সূর্য সূয্যি বৃষ্টি বিষ্টি ক্ষুধা খিদে জ্যোৎস্না জোছনা
শ্রী ছিরি গ্রাম গেরাম নিমন্ত্রণ নেমন্তন্ন শ্রাদ্ধ ছেরাদ্দ
গৃহিণী গিন্নি ঘৃণা ঘেন্না কর্ণ কান স্বর্ণ সোনা
৩. তদ্ভব শব্দ : যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে প্রাকৃতভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলে। তদ্ভব শব্দের বানানে ঈ-কার হয়ে যায় ই-কার। ঊ-কার হয়ে যায় উ-কার। ণ-হয়ে যায় ন। য-ফলা থাকে না। যেমন: গা, ঘরনি, কানাই/কানু, বোশেখি, সুয্যি, সোনা, সন্ধে, পহেলা/পয়লা। কিছু তদ্ভব শব্দের নমুনা:
তদ্ভব শব্দ <সংস্কৃত শব্দ
অপরূপ < অপূর্ব
অমিয় < অমৃত
অলখ < অলক্ষে
আইচ < আদিত্য
আখড়া < অক্ষবাট
আঁখি < অক্ষি
আঁচল < অঞ্চল
আজ < অদ্য
আঁটি < অস্থি
আড়াই < অর্ধতৃতীয়
আদিখ্যেতা < আধিক্যতা
আন্ধার < অন্ধকার
আপন < আত্মপন
আমড়া < আম্রাতক
আমি < অস্মাভি
আরশি < আদর্শিকা
আলতা < অলক্তক
আশি < অশীতি
আঁশ < অংশু
আষ < আমিষ
আস্তাবল <stable
আনারস <Ananos
আলমারি < Armario
ইট < ইষ্টক
ইঁদারা < ইন্দ্রাগার
উন্মনা < উৎমনা
উনুন < উষ্মাপন
উবু < ঊর্ধ্ব
এগার < একাদশ
এয়ো < অবিধবা
ওঝা < উপাধ্যায়
কনে < কন্যা
কনুই < কফনিকা
কলা < কদলি
কাছাড়ি < কৃত্যগৃহ
কাঁথা < কন্থা
কাঁদন < ক্রন্দন
কানু < কৃষ্ণ
কাম < কর্ম
কামার < কর্মকার
কাহন < কার্যাপন
|
তদ্ভব শব্দ <সংস্কৃত শব্দ
কুমার < কুম্ভকার
কুঁড়ি < কোরক/কমডল
কেয়া < কেতকী
খই < খদিকা
খাজা < খাদ্য
খুদ < খুদ্র
খেয়া < ক্ষেপ
গরজে < গর্জে
গা < গাত্র
গাঁ < গ্রাম
গাং < গঙ্গা
গাজন < গর্জন
গামছা < গামোছা
গারদ < Guard
গুয়া < গুবাক
গোলাপ < গুলো+আব (ফা.)
গোয়াড়ি < গোপবাটিকা
ঘর < গৃহ
ঘরনি < গৃহিণী
চাকা < চক্র
চিড়া < চিপিটক
চৌকা < চতুঙ্ক
ছা < শাবক
জাঁদরেল < General
ঝি < দুহিতা
ঠাঁই < স্থানিক
ঠোঁট < তুণ্ড
দেউটি < দীপবর্তিকা
দুয়ার < দ্বার
দেরাজ < Drawer
নতুন < নূতন
নিশ্চুপ < নিশ্চল+চুপ
পরশে < স্পর্শে
পরান < প্রাণ
পয়লা < প্রথমিল
পাখা < পক্ষ
পুষ্পারতি < পুষ্প+আরতি
পেঁপে < পাপাইয়া (পর্তু)
পোলা < পোতক
ফিরিঙ্গি < Frank
বাঁদর < বানর
|
তদ্ভব শব্দ <সংস্কৃত শব্দ
তদ্ভব শব্দ সংস্কৃত
বুক < বক্ষ
বুনো < বন্য
বেহুলা < বিপুলা
বোঁচকা < বোগচা (তুর্কি)
বোঁটা < বৃন্ত
ভাত < ভত্ত
ভালো < ভদ্রক
মঞ্চ < মর্ত্য
ময়দা < সেমিদালিস
মাইরি < mary
মাছ < মৎস্য
মাঝ < মধ্য
মাটি < মৃত্তিকা
মাথা < মস্তক
মিনতি < মিন্নত (ফা.)
মেজো < মধ্যক
মোছ < মচ্ছু <শ্মশ্রু
রাখাল <রক্ষপাল
লাট < Lord
শিউলি < শেফালিকা
সতীন < সপত্নী
সঁপা < সমর্পণ
সমঝোতা < সমঝৌতা
সরগ < স্বর্গ
সাঁই < স্বামী
সাঁওতাল < সামন্তপাল
সাঁকো < সংক্রম
সাত < সপ্ত
সাপ< সর্প
সায়র < সাগর
সিঙ্গারা < শৃঙ্গটাক
সিঁথি < সিমন্তিকা
সুন্দর < সুনর
সেজো < সিহ+জ (ফা.)
সেয়ানা < সজ্ঞান
সোনা < স্বর্ণ
সোহাগ < সৌভাগ্য
হাঁটা < হণ্টন
হালকা < লঘুক
গেন্ডারিয়া <Grand Area
|
৪. আঞ্চলিক শব্দ : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত শব্দকে আঞ্চলিক শব্দ বলে। যেমন: হাত>ড্যানা, ষাঁড়>হাঁড় ইত্যাদি।
৫. দেশি শব্দ : যেসব শব্দ বাংলার আদিবাসীদের (যারা অনার্য যেমন: কোল, মুন্ডা) ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় রক্ষিত আছে তাদের দেশি শব্দ বলে। যেমন: কুলা, চুলা, কুড়ি, পেট ইত্যাদি।
৬. প্রাদেশিক শব্দ : সংস্কৃত বাদে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ভাষা থেকে আগত শব্দকে প্রাদেশিক শব্দ বলে। এর বানান পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রাদেশিক শব্দ ব্যবসা, বাণিজ্য, মিডিয়ার বদৌলতে বাংলা ভাষায় নিজস্ব স্থান দখল করে চলেছে। তারমধ্যে হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি উল্লেখযোগ্য। যেমন:
হিন্দি শব্দ : কাহানি>কাহিনি, ঠান্ডি>ঠান্ডা, পহেলা, দোসরা, ঠিকানা
পাঞ্জাবি শব্দ : শিখ, চাহিদা
গুজরাটি শব্দ : হরতাল, খদ্দর
মারাঠি শব্দ : চৌথ বর্গি
সাঁওতালি শব্দ : হাড়িয়া, কম্বল
তামিল শব্দ : খুকি, কলা/Art, গুরুট>চুরুট
৭. বিদেশি শব্দ : বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষী মানুষের মাধ্যমে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের বিদেশি শব্দ বলে। বিদেশি শব্দে সবসময় ই/উ-কার বসে ঙ/ছ/ঞ্জ/ঞ্চ/ণ/ণ্ট/ণ্ড/ষ্ট না বসে ং/স/শ/নজ/ নচ/ন/ ন্ট/ন্ড/স্ট বসে। যেমন: আল্লাহ, ফেরেস্তা, স্কুল/কলেজ, আঁশ, জানালা, সাবান, টেক্কা, কাঁচি, লাশ, চা, চিনি, রিকশা, লুংগি, ডেংগু, ঝান্ডা, লন্ঠন, মিসরি, পসন্দ, তির (ধনুক), ইনজিনিয়ার, সেনচুরি, ব্যাংক, ইনজিন, এন্ড, খ্রিস্টার্ন, স্টল, স্টেশন, স্টোর।
বিদেশি বা অন্যভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় আগত শব্দকেই বিদেশি বা আগন্তুকশব্দ বলে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সেমিটিক/পহলবি (ফারসি) ভাষা থেকে আগত শব্দগুলো ইসলামি সংস্কৃতির শব্দ বলা হয়। এ শাখায় রয়েছে আরবি ফারসির তুর্কি ভাষার শব্দ। বাংলা ভাষায় এসবশব্দের প্রবেশের কারণ ছিল মুসলমান শাসন। তেরশতক থেকে আঠারশতক পর্যন্ত ফারসি রাজভাষা থাকার কারণে ফারসি শব্দ এবং ফারসি শব্দের আশ্রয় নিয়ে আরবির তুর্কি শব্দ প্রবেশ করে। বাংলা ভাষায় প্রায় আড়াই হাজারের মতো আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ রয়েছে। পুরোনো বাংলায় এসব শব্দ না থাকলেও মধ্যযুগ থেকে এসব শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। কিছু বিদেশি শব্দের নমুনা:
তুর্কি শব্দ : চাকু, চাকর, তোপ-দারোগা/তুর্কি বলে ধার ধারোগা।
ইংরেজি শব্দ : ইংরেজি শব্দ দুপ্রকার।
অনেকটা ইংরেজি উচ্চারণে: ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, কলেজ, টিন, নভেল, নোট, পাউডার, পেন্সিল, ব্যাগ।
পরিবর্তিত উচ্চারণে : পরিবর্তিত উচ্চারণে অনেক শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন: গুদাম, পাউরুটি।
চিনা শব্দ : চা, চিনি, লিচু।
জাপানি শব্দ : রিকশা, হারিকিরি, হাসনাহেনা।
বর্মি শব্দ : লুংগি, ফুংগি।
৮. পারিভাষিক শব্দ : বিশেষ অর্থ প্রকাশের জন্য ইংরেজি থেকে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের পারিভাষিক শব্দ বলে। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলা ভাষার প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে। যেমন:
পাঠ্যসূচি—syllabus, আইন—act, অম্লজান—oxygen, উদযাপন—hydrogen, নথি—file, প্রশিক্ষণ— training, ব্যবস্থাপক—manager, বেতার—radio, মহাব্যবস্থাপক—general manager, সচিব— secretary, স্নাতক—graduate, স্নাতকোত্তর—post greduate, সমাপ্তি—final, সাময়িকী—periodical, সমীকরণ— equation। উপরের ৮ প্রকার ছাড়াও আরো কিছু শব্দ মৌখিকভাবে তৈরি হয়েছে যা সাধিতশব্দ। যেমন: গুলমারা, গ্যাজানো।
0 comments:
Post a Comment