এক অন্যরকম উত্তরপত্র

Thursday, 6 April 2017

ভাষা, ভাষার বৈশিষ্ট্য, ভাষার পরিচয়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি, ভাষার রীতি

ভাষা, ভাষার বৈশিষ্ট্য, ভাষার পরিচয়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি, ভাষার রীতি


ভাষা
মানুষ তার ভাব, ভাবনা, চিন্তা ইত্যাদি ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ করার জন্য অর্থাৎ নিজেদের প্রয়োজনেই নিজেরাই ভাষা গড়ে তুলেছে। ভাষার বৈশিষ্ট্য হলো বদলে যাওয়া। ভাষার বিবর্তনধারা লক্ষ করেই পণ্ডিতগণ ‘প্রাচীন বাংলা’, ‘মধ্যযুগীয় বাংলা’ অথবা ‘আধুনিক বাংলা’ নাম দিয়েছেন। প্রাচীন বাংলার আদিতম নিদর্শন ‘চর্যাপদের’ ভাষার সঙ্গে তাই আদি মধ্যযুগের বাংলা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ ভাষার পার্থক্য রয়েছে। আবার এগুলোর সঙ্গেও পার্থক্য দেখা যায় অন্ত্যমধ্যযুগের বাংলা, আলাওলের কাব্য ‘পদ্মাবতী’ কিংবা ভারতচন্দ্রের কাব্য ‘অন্নদামঙ্গলে’। অথবা ষোড়শ শতকের চিঠিপত্রে বা দলিলাদিতে যে বাংলা গদ্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে সেসব ভাষানিদর্শনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ভাষারও পার্থক্য রয়েছে। যেমন রয়েছে বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের ভাষার সঙ্গে আর রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ চৌধুরী’র ভাষার।
ভাষার সংজ্ঞা
মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যমকে ভাষা বলে। অথবা মানুষ মুখে উচ্চারিত অর্থবোধক বা বোধগম্য কথাকে ভাষা বলে। অথবা বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি অথবা শব্দ বা শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে যা মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করে। অথবা কোন সম্প্রদায় বা জাতির মনের ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত অর্থবোধক শব্দ বা বাক্যকে ভাষা বলে। অথবা মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা জনসমাজে কৌশলে উচ্চারিত অপরের কাছে বোধগম্য তার নাম ভাষা।
ভাষা সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানীদের দেওয়া সংজ্ঞা
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: মনুষ্য জাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তাহার নাম ভাষা।
মুহাম্মদ আব্দুল হাই: এক এক সমাজে সকল মানুষের অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।
ড. মুনীর চৌধুরী: ভাষা মানুষে মানুষে সম্পর্ক স্থাপনের প্রধানতম সেতু, সামাজিক ক্রিয়া কর্ম নির্বাহের অপরিহার্য মাধ্যম, সভ্যতার সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ভাষা সাহিত্যের বাহন, ভাবের আধার, অবেগের মুক্তিপথ, চিন্তার হাতিয়ার।
ভাষাগবেষক সুকুমার সেন: মানুষের উচ্চারিত অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনি সমষ্টিই ভাষা।
সুকুমার সেনের এই কথায় বোঝা যায়, ভাষার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো মানুষের মনে স্পৃহার অনুকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা।
ভাষাবিজ্ঞানী স্টার্টেভান্ট: A language is a system of arbitraryvocal symbols by which members of a social group co-operate andinteract.
ভাষার বৈশিষ্ট্য
মনের ভাব প্রকাশ ছাড়াও ভাষার আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন:
১. ভাষা কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি দ্বারা গঠিত।
২. ভাষায় অর্থদ্যোতকগুণ বিদ্যমান।
৩. ভাষা একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ও ব্যবহৃত।
৪. ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোন বিশেষ জনসমাজে কৌশলে উচ্চারিত স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত শব্দসমষ্টি।
৫. ভাষা মানবসৃষ্ট প্রধান মাধ্যম।
৬. ভাষা মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম বা ভাষা পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় ও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।
৭. ভাষা মুখে বা বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবোধক বা বোধগম্য কথা।
৮. ভাষা মানুষের স্বেচ্ছাকৃত আচরণ ও অভ্যাসের সমষ্টি।
১০. ভাষা ধ্বনি, শব্দ, পদ ও বাক্যের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিণ গাঠনিক পর্যায় রক্ষাকারী শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
মানুষের কাছে ভাষার গুরুত্ব অনেক। ভাষা আছে বলেই মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারে। সকল প্রকার যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। ভাষা প্রকাশের সঙ্গে দৈনন্দিন সকল কাজের মিল আছে বলেই জীবন এতো সহজ হয়ে যায়।
ভাষার পরিচয়
শব্দে শব্দে তৈরি হতে থাকল ভাবের ভুবন। যার নাম ভাষা। বহু বছরের সাধনায় তৈরি এই ভাষার জন্ম দিনক্ষণটির বয়স প্রায় এক লক্ষ বছর। আর লেখার জন্ম? মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগে। জায়গাটি ছিল মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় অঞ্চল। সেখানকার মানমন্দিরের দানের হিসাব রাখার জন্য মাটির ফলকে কাঠি দিয়ে লেখাই পৃথিবীর প্রথম লেখা।
বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-এ ভাষার জৈব-তাত্ত্বিক ভিত্তি অংশে হাকিম আরিফ দেখাতে চেয়েছেন, মস্তিষ্কে ভাষা উৎপাদন ও উপলব্ধির নির্দিষ্ট অঞ্চল রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলেছেন-ফরাসি স্নায়ু বিজ্ঞানী পল ব্রোকা ও জার্মান স্নায়ু তাত্ত্বিক কার্ল ভেরনিক মানুষের মস্তিষ্কের দুটি অঞ্চল আবিষ্কার করেছেন, ‘ভাষা উৎপাদক’ ও ‘ভাষা উপলব্ধি’ কেন্দ্র সনাক্ত করেন। এই দুটি অঞ্চলের নাম দেয়া হয়েছে ‘ব্রোকা অঞ্চল’ ও ‘ভেরনিক অঞ্চল’। মানুষের মস্তিষ্কের এই চিরায়ত ভাষিক এলাকা ছাড়াও ভেরনিক এলাকার পার্শ্ববর্তী আরও দুটি এলাকা রয়েছে, তা হলো-এংগিউলার জাইরাস ও সুপরা মারজিনাল জাইরাস ভাষার বর্ণ সনাক্তকরণ ও পঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি, জন্ম, পরিচয় ও বিবর্তন বা ক্রমবিকাশ
বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলে তাকে বাংলা ভাষা বলে। চলিত ভাষার প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরীর মতে—‘যে ভাষা আমরা (বাঙালিরা) সকলে জানি, শুনি ও বুঝি, যে ভাষায় আমরা ভাবনা চিন্তা সুখদুঃখ বিনা আয়াসে, বিনা ক্লেশে বহুকাল হতে প্রকাশ করে আসছি এবং সম্ভবত আরও বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশ করব, সেই ভাষাই বাংলা ভাষা।’ তবে বর্তমানে বাঙালি ছাড়াও অনেক জাতিসত্ত্বার মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।
ইন্দোইউরোপীয় ভাষা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তর ভাষাগোষ্ঠী হিসাবে বিবেচিত। এই ভাষা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইয়োরোপ, এশিয়ার ইরান ও ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে। এই ভাষাগোষ্ঠীর মূল আবাসভূমি ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষ্ণসাগরের নিকটবর্তী উত্তরে দানিয়ুব নদীর মুখ থেকে কাস্পিয়ান সাগরের অঞ্চলবর্তী ভূখণ্ডে। পরবর্তিকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মূল অঞ্চল থেকে ভাষাভাষীরা ইয়োরোপের পশ্চিম অঞ্চলে ক্রমশ অগ্রসর হওয়ার পর একটি দল প্রথমে ইরানে প্রবেশের পর সেখান থেকে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। তারা ভারতের উত্তরাঞ্চলে বসবাসের পর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন সময়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যাযাবর ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীরা উত্তর ভারতে স্থায়ী বসবাসের সময় সেখানে বসবাসরত অনার্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘর্ষে অনার্য ভাষাভাষীরা পরাজিত হলে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে সরে আসে। আর্যদের ভারতে অনুপ্রবেশের পূর্বে সিন্ধু উপত্যকায় উন্নত সভ্যতার অধিকারী অনার্য সম্প্রদায় বসবাস করতেন। যাঁদের সভ্যতা মেসোপটোমিয়ার নীল উপত্যকায় সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। মহেঞ্জোদারোর হরপ্পা খননের পর প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন দিক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। অনার্য সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে ওঠে। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় সম্প্রদায় ছাড়াও ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাঁওতাল, মুন্ডার অন্যান্য সম্প্রদায়ের অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বসবাসরত। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলেও বহিরাগত আর্য সম্প্রদায় স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর প্রভাব বিস্তারসহ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। দানিয়ুব নদীর কৃষ্ণসাগর থেকে মূল ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী ইয়োরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, ইরানর ভারতে বসবাসের পর মূল ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর প্রত্যেক অঞ্চলে মূল ভাষা পরিবর্তিত হয়ে আঞ্চলিকরূপ লাভ করে। এই পরিবর্তন সত্ত্বেও ইরানীয় ও ভারতীয় ভাষায় ব্যবহৃত রূপমূলের সঙ্গে আংশিক হলেও ধ্বনিগত মিল পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষার বিভিন্নরূপ ও রীতি
আধুনিক বাংলা উদ্ভবের পর থেকে সাধু, চলিত ও আঞ্চলিক এই তিন রকম রীতি প্রচলিত। এই তিন রীতির মধ্যে পার্থক্য মূলত ক্রিয়ার সর্বনাম এবং রূপমূল ব্যবহারের ক্ষেত্রে। চলিত বা প্রমিতরীতিতে সাধুরীতির রূপমূল অপেক্ষাকৃত সংকুচিত(রৌদ্র>রোদ, মস্তক>মাথা, তাহার>তার)। বাংলার প্রমিতরূপ নদীয়ার কৃষ্ণনগর অঞ্চলের কথ্যরূপ অবলম্বনে গঠিত হলেও পরবর্তিতে ঢাকার কলকাতার প্রমিতরূপের মধ্যে উচ্চারণভঙ্গির রূপমূলের ব্যবহারগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় (ঢাকা ‘যাচ্ছেন’, কলকাতা ‘যাচ্চেন’, ঢাকা ‘বের হয়ে গেল’, কলকাতা ‘বার হয়ে গেল’, ঢাকা ‘বিশ’, কলকাতা ‘কুড়ি’)। বাংলাভাষা প্রকাশের দুইটি রূপ বা রীতি আছে। যেমন: কথ্য ও লেখ্য রীতি।
কথ্যরীতি
কথার ভাষাই কথ্য। (কথ্য ভাষা=মুখের ভাষা) কোলকাতার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের মৌখিক মান ভাষাটিই বর্তমানে লেখার ভাষা হিসাবে সচল। সাধু ভাষাও একসময় কথার ভাষাই ছিল। পৃথিবীর প্রায় আট থেকে দশ হাজার ভাষার মধ্যে অধিকাংশই উপভাষা। কথ্যভাষা সাধারণত কোন ব্যাকরণ অনুসরণ করে না। কথ্যভাষার রূপ তিনটি: আঞ্চলিক উপভাষা, সমাজ উপভাষা, প্রমিত চলিত কথ্য। যেমন :
আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা
বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভাষা প্রচলিত সেই ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে। যে ভাষা শিশু প্রাকৃতিক নিয়মে শেখে, যার লিখিত কোন ব্যাকরণ নাই, যে ভাষা অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয় সেই ভাষাই আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা। প্রায় ত্রিশ মাইল অন্তর এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তনে উচ্চারণ দোষ বা নানারকম ভুল থাকে। তাই নদীয়া বা পুরুলিয়া, চাটগাঁ ও ময়মনসিংহের ভাষায় যথেষ্ট ভিন্নতা পাওয়া যায়। আবার কুষ্টিয়ার সঙ্গে কোলকাতা, ত্রিপুরার সঙ্গে চট্টগ্রামের, সিলেটের সঙ্গে আসাম সংলগ্ন অঞ্চলের ভাষার ঐক্যও খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় অসংখ্য উপভাষা রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধানগুলো হলো: রাঢ়ি উপভাষা (উত্তর ও দক্ষিণ), ঝাড়খণ্ডি উপভাষা, বরেন্দ্রি উপভাষা (পশ্চিম), কামরূপি উপভাষা (উত্তর ও পশ্চিম) ইত্যাদি। একই আচার রীতিনীতি এমনকি একই সংরক্ষিত এলাকার একই গোত্র বা সমাজের মানুষের একই রকমের ছাঁদের প্রচলিত ভাষাই আঞ্চলিক উপভাষা। একটি ভাষার অন্তর্গত এমন একটি বিশেষরূপ যা একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত থাকে এবং যার সঙ্গে সেই আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনির রূপগত পার্থক্য সৃষ্টি করে। উপভাষা সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন, কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চলে বিশেষে প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা বলে। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই উপভাষা আছে। উপভাষায় রচিত প্রাচীন মৌখিক সাহিত্যই ‘লোক সাহিত্য’, উপভাষার শব্দাবলির মধ্যে রয়েছে একটি জাতির ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিকর সামাজিক পরিচয়, মূল্য মান ভাষার একান্ত আঞ্চলিক রূপটি আছে উপভাষাতেই, আছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য, বিশেষ অঞ্চলের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষা এবং অকৃত্রিম সারল্য। উপভাষার মধ্যে রয়েছে কোনো ভাষার মূলশক্তি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে বলেছেন—ভাষার জীবন্তরূপ তাহার কথ্য ভাষায়। স্থান ভেদে বাঙ্গালার কথ্যরূপ নানাবিধ—
অঞ্চল                আঞ্চলিক ভাষার নমুনা
খুলনা, যশোহর               : অ্যাক জন মানশির দুটো ছাওয়াল ছিল।
মানভূম                        : এক লোকের দুটো বেটা ছিল।
রাঁচি (সরাকি)                : এক লোকের দু বেটারাহে।
সিংহভূমি (ধলভূম)          : এক লোকের দুটা ছা ছিল।
মেদিনীপুর (দক্ষিণ পশ্চিম)  : এক লোক্কর দুট্টা পো থাইল।
পূর্ণিয়া (সিরিপুরিয়া)          : এক ঝনের দুই পুআ ছিল।
মালদা                         : য়্যাক ঝোন ম্যান্শের দুটা ব্যাটা আছ্লো।
বগুড়া                        : য়্যাক ঝনের দুটা ব্যাটা আছিল।
রংপুর                         : এক জন ম্যানশের দুইক্না ব্যাটা আছিল্।
ঢাকা                       : একন মানশের দুইডা পোলা আছিল।
ময়মনসিংহ                  : য়্যাক জনের দুই পুৎ আছিল্।
সিলেহেট                    : এক মানুশর দুই পুয়া আছিল্।
কাছাড়                    : এক জন মানুশর দুগুয়া পুয়া আছিল্।
চট্টগ্রাম                    : এগুয়া মানশের দুয়া পোয়া আছিল্।
নোয়াখালি              : একজনের দুই হুত আছিল।
চট্টগ্রাম (চাকমা)         : এক জন তুন দিবা পোয়া এল্।
মণিপুর (মায়াং)         : মুনি আগোর পুতো দুগো আসিল্।

সমাজ উপভাষা
সমাজের ব্যবহৃত ভাষাই সমাজ উপভাষা। অন্যভাবে বলা যায়, সমাজের মধ্যে যেসব ভাষা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ব্যবহার করে সেসব ভাষাকে সমাজ উপভাষা বলে। সামাজ উপভাষা নির্ণয় করার সহজ উপায় মানুষের শিক্ষাদীক্ষার অবস্থান। একজন শিক্ষিত লোক যেভাবে কথা বলে, একজন অশিক্ষিত লোক সেভাবে কথা বলে না। যেভাষা মানুষের সামাজিক পরিচয় বহন করে সেভাষাই সমাজ উপভাষা। সমাজ উপভাষা সৃষ্টির প্রধান কারণ হলো সামাজিক শ্রেণি বিভাজন ও সীমারেখার প্রতিবন্ধকতা। নমুনা হিসেবে দেখা যায়, আমি কাজটি করছি/আমি কাজটি করতাছি/আমি কাজটি করতেছি। সমাজে যেসব স্তর আছে তাদের ভাষারীতি আলাদা, ভাষা অভ্যাসও আলাদা। এই পার্থক্য বক্তা, শ্রোতা, উপলক্ষ্য বা পরিস্থিতি অনুসারে আলাদা হয়। উচু ও নীচু সমাজের ভাষাও আলাদা হয়ে থাকে। অন্যদিকে একই সমাজে বা অঞ্চলে বসবাস করলেও ভাষার ভিন্নতা হতে পারে। যেমন : নারী-পুরুষ অথবা তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়ে) মানুষের ভাষা পার্থক্য দেখা যায়। বয়সের কারণেও ভাষা ব্যবহারের ধরণ আলাদা হতে পারে। বিত্ত, জীবিকা, শিক্ষা ইত্যাদির প্রভাবে মান্য বা শিষ্ট ভাষাও কিছুটা পরিবর্তিত হয়। ফলে সমাজের মধ্যে মান্য ভাষার একাধিকরূপও ব্যবহার হতে থাকে। আর্থিক উন্নতির ফলে সমাজে মানুষের মধ্যে পার্থক্য হয় এবং বিভিন্ন স্তর বা শ্রেণি সৃষ্টি হয়। সেই স্তরে ভাষা অভ্যাসেরও পরিবর্তন হয়। ভাষাবিজ্ঞানী ব্লুমফিল ভাষার এই স্তরকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন : সাহিত্যক আদর্শ, আদর্শ চালিত, প্রাদেশিক আদর্শ, আদর্শের ভাষা, স্থানীয় উপভাষা। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ব্যবহৃত হয়।
প্রমিত চলিত কথ্য
অনেক সময় দেখা যায়, উপভাষাগুলো সব এলাকার সব লোকের কাছে বোধগম্য হয় না। তাই উপভাষাকে উপলক্ষ করে সবার বোধগম্য ব্যাকরণ সম্মত একটি আদর্শভাষা তৈরি করা হয় এই আদর্শভাষাই প্রমিত চলিত কথ্য ভাষা। এই ভাষাই হয়ে ওঠে সকল ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। প্রমিত চলিত ভাষার লিখিত ব্যাকরণ দরকার হয় এবং চর্চার মাধ্যমে শিখতে হয়। তবেই ভাষা আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে ওঠে সার্বজনীন, রাষ্ট্রীয়। নির্দিষ্ট ওই ভাষা দীর্ঘ প্রাণশক্তি সঞ্চিত করে। টিকে থাকে কাল-মহাকাল।
লেখ্যরীতি
মুখের ভাষাকে লিখিতভাবে প্রকাশ করাকে লেখ্যরীতি বলে। লেখ্যরীতির ২টি রূপ রয়েছে। যেমন :
সাধু লেখ্য
সংস্কৃত ভাষার সংস্কার বা এই ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রেখে যে ভাষা তৈরি হয় সেই ভাষাকে সাধুভাষা বলে। চলিত ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির আগপর্যন্ত যে ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি হতো সেই মার্জিত লিখিত ভাষাকে সাধুভাষা বলে। অথবা সাধু পণ্ডিতদের দ্বারা কৃত্রিমভাবে তৈরিকৃত লেখার উপযোগী ভাষাকে সাধুভাষা বলে।
বৈদিকভাষার সংস্করণ হলো সংস্কৃত বা তৎসমভাষা আর সংস্কৃতভাষার সংস্করণ হলো সাধুভাষা। এভাষা মিশনারির মুনশিদের হাতে গড়ে উঠলেও সাধু নামটি দেন রাজা রামমোহন রায়। অনেকে বলে থাকেন সাধুভাষা মৃত। ভাষার কাজ যে কোনভাবে অন্যভাষার মধ্যে নিজেকে জীবিত রাখা। সাধু ভাষার প্রাণ সঞ্চার করেন ঈশ্বরচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্র। এখনও কলকাতার দুই একজন লেখক সাধুভাষায় লেখেন। কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ আর বাংলাদেশের ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এখনও সম্পাদকীয় সাধুভাষায় লেখা হয়। এছাড়া আরও কিছু ক্ষেত্রে যেমন সরকারি অফিসের বিজ্ঞপ্তি, দরপত্র, কোন কোন মামলা মোকদ্দমায় সাধুরীতির প্রচলন রয়েছে।
প্রমিত চলিত লেখ্য
প্রমিত চলিত কথ্যভাষার লেখ্যরূপকেই প্রমিত চলিত লেখ্যরীতি বলে। কোলকাতার ভাগীরথী তীরের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থেকে প্রথম লিখিত ভাষায়রূপ দান করেন প্যারীচাদ ও কালীপ্রসন্ন তাঁদের উপন্যাসে। এইজন্য এই ভাষাকে আলালি-হুতোমি ভাষাও বলা হতো। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরীসহ অনেকেই চলিত ভাষায় লিখেছেন। প্রমিত চলিত লেখার ক্ষেত্রে ১৯১৪ সালে প্রকাশিত সবুজপত্রের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
বাংলা ভাষায় সাধু ও চলিত রীতির মধ্যে পার্থক্য
ধরন
সাধুরীতি
চলিত রীতি
সংজ্ঞা

বাংলা ভাষায় সাধুরীতি সংস্কৃত ভাষাঘনিষ্ট পণ্ডিত, বোদ্ধা লেখকদের এক লেখার উপযোগী প্রায় কৃত্রিম ভাষা। চলিত রীতিতে সাহিত্য সৃষ্টির আগপর্যন্ত যে ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি হতো সেই মার্জিত লিখিত বাংলা ভাষাকেই সাধুভাষা বা সাধুরীতি বলে।
অথবা সাধু পণ্ডিতদের দ্বারা কৃত্রিমভাবে তৈরিকৃত লেখার উপযোগী ভাষাকে সাধুভাষা বলে।
সাধু ভাষার রক্ষণশীলবৃত্ত ভেঙে সৃষ্টি হলো বাংলা ভাষার চলিত রীতি। স্বাভাবিকভাবে উৎপন্ন এবং প্রচলিত আদর্শ প্রমিত ভাষাকে চলিতভাষা বলে।
অথবা বর্তমানে সব ধরণের বই, পত্রিকা, পোস্টার ইত্যাদি যে ভাষায় প্রকাশ হচ্ছে তাকেই চলিতভাষা বলে।

বৈশিষ্ট্য
১. তৎসমশব্দের প্রাধান্য বেশি
২. কঠিন ও গম্ভীর স্বভাবের
৩. লেখার উপযোগী আর বলার অনুপযোগী
৪. নাটকের সংলাপ, চিঠির বক্তৃতার অনুপযোগী
৫. আঞ্চলিক প্রভাবমুক্ত
৬. কৃত্রিম ও অপরিবর্তনশীল
৭. বানান নির্দিষ্ট বা অপরিবর্তনশীল
৮. এর প্রচারক রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র
৯. পুরোপুরি ব্যাকরণ মেনে চলে   
১. তদ্ভবশব্দের প্রাধান্য বেশি
২. সহজ ও সাবলীল স্বভাবের
৩. লেখা ও বলা দুইয়ের উপযোগী
৪. নাটকের সংলাপ, চিঠির বক্তৃতার উপযোগী
৫. আঞ্চলিক প্রভাবযুক্ত
৬. অকৃত্রিম ও পরিবর্তনশীল
৭. বানান অনির্দিষ্ট বা পরিবর্তনশীল
৮. প্রমথ চৌধুরী চলিত গদ্যের প্রচারক
৯. সংস্কৃত ব্যাকরণ মেনে চলে না

শব্দগঠন
১. বিশেষ্য, যোজক, ক্রিয়া, সর্বনাম ও অনুসর্গের পূর্ণরূপ বসে। যেমন: মস্তক, যদ্যপি, সহসা, করিতেছি, করিতে, থাকিব, তাহাদের, যাহা, ধরিয়া, সবচেয়ে, ব্যতিত।
২. সমাসবহুল শব্দ বেশি। যেমন: মাতৃভূমি, বেত্রাঘাত।   
১. বিশেষ্য, যোজক, ক্রিয়া, সর্বনাম ও অনুসর্গের খণ্ডরূপ বসে। যেমন: মাথা, আজ, হাত, যদিও, হঠাৎ, করছি, করতে, থাকব, তাদের, যা, ধরে, সবচে, ছাড়া ইত্যাদি।
২. বিভক্তির কারণে সমাসবহুল শব্দ কম। যেমন: মায়ের ভূমি, চাবুক মারা বা চাবুকের আঘাত।
বাক্যগঠন
১. বাক্য গঠন সবসময় অপরিবর্তনশীল। যেমন: কর্তা+ কর্ম+ক্রিয়া (সাধারণ গঠন)। তবে বাক্যে অন্যান্য শব্দ থাকলে পরিবর্তন করা যায় না। যেমন: সারথি কশাঘাত করিবামাত্র, অশ্বগণ বায়ুবেগে ধাবমান হইল।
২. সাধু ও চলিতভাষার মিশ্রণে বাক্যগঠন দোষণীয় নয়।
৩. দুটি বহুবচন চিহ্ন বসার নিয়ম আছে। যেমন: শিক্ষক রুমে ঢুকামাত্র ছেলেগুলো সব দাঁড়াল।
৪. দুটি নারী চিহ্ন বসার নিয়ম আছে। যেমন: মেয়েটি সুন্দরী বা কুলসুম সুন্দরী বা কুলসুম অস্থীরা।
৫. ক্ষুদ্রার্থক শব্দ নারী বাচক হয়। যেমন: পুস্তিকা, নাটিকা, উপন্যাসিকা ইত্যাদি।
১. বাক্য গঠন সবসময় পরিবর্তনশীল। যেমন: কর্তা+কর্ম+ক্রিয়া বা কর্তা+ ক্রিয়া + কর্ম বা অন্যান্য পদে হয় তবে বাক্যে অন্যান্য শব্দ থাকলে পরিবর্তন করা যায়। যেমন: সারথি চাবুক মারা মাত্র ঘোড়াগুলো বায়ুবেগে বা বাতাসের গতিতে চলতে শুরু করল। এই বাক্যের শব্দগুলো অন্যভাবে সাজানো যেতে পারে।
২. সাধু ও চলিত মিশ্রণে বাক্যগঠন দোষণীয়। এটি যে কোন শব্দ গঠনে হতে পারে।
৩. দুটি বহুবচন চিহ্ন বসার নিয়ম নাই। যেমন: শিক্ষক রুমে ঢুকামাত্র ছেলেগুলো দাঁড়াল।
৪. দুটি নারী চিহ্ন বসার নিয়ম নাই। যেমন: মেয়েটি সুন্দরী বা কুলসুম সুন্দরী বা কুলসুম অস্থীর।
৫. ক্ষুদ্রার্থক শব্দ নারী বাচক হয় না। যেমন: পুস্তিকা, নাটিকা, উপন্যাসিকা ইত্যাদি।
সাধুর চলিত বাক্যরূপান্তরের নমুনা
সাধু : কতিপয় পদ গমন করিয়া, শকুন্তলার গতি ভঙ্গ হইল। শকুন্তলা, আমার অঞ্চল ধরিয়া কে টানিতেছে; এই বলিয়া মুখ ফিরাইলেন।
চলিত : কয়েক পা গিয়ে শকুন্তলার গতি থেমে গেল। শকুন্তলা, আমার আঁচল ধরে কে টানছে, এই বলে মুখ ফেরালেন।
সাধু : কল্য যে ভূম্যধিকারীর লক্ষ মুদ্রারাজস্ব ছিল, অদ্য হইতে তাহাতে আর পঞ্চাবংশতি সহস্র যুক্ত হইল। অতএব ইজারার নাম শুনিলেই প্রজাদের হৃৎকম্প না হইবে কেন?
চলিত : কাল যে জমিদারের লাখ টাকা খাজনা ছিল, আজ থেকে তাতে আর পঁচিশ হাজার যোগ হলো। কাজেই ইজারার নাম শুনলেই প্রজাদের বুক কাঁপবে না কেন?
সাধু : গ্রামের মধ্যে যিনি অন্যান্য অপেক্ষায় কিঞ্চিৎ ধনবান তাঁহার অভিলাষ যে আর সকলেই তাহার দ্বারস্থ থাকে-সকলেই তাহার দাস হইয়া সেবা করে।
চলিত : গাঁয়ের মাঝে যিনি আর অন্যদের চেয়ে সামান্য ধনী তাঁর ইচ্ছে যে আর সবাই তার দোরে আসে, সবাই তাঁর গোলাম হয়ে সেবা করে।  

ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব

ব্যাকরণ ও ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব

ভাষা মানুষকে মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করে আর ব্যাকরণ সেই ভাষাকে সুন্দর, শুদ্ধ ও শৃংখলাবদ্ধ করতে সাহায্য করে। ভাষার গতি ব্যাকরণের উপর নির্ভরশীল নয় তবুও ব্যাকরণ দিয়ে ভাষার পরিবর্তনের নিয়ম নির্ধারণ করা হয়। ব্যাকরণ মেনেই ধ্বনি বদলে যায়, ভাষাও বদলে যায় এবং ব্যাকরণকেও বদলে যেতে হয়। ব্যাকরণ শব্দের অর্থ বিশেষভাবে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। বিভিন্নভাবে ব্যাকরণের সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে। যেমন : কোন ভাষায় ‘সঠিকভাবে’ বলা ও লেখার বিদ্যাকে ব্যাকরণ বলে। অথবা ভাষাকে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মকে ব্যাকরণ বলে। অথবা মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা আর ভাষাকে শুদ্ধভাবে পড়তে, বুঝতে, লিখতে ও বলতে পারার নিয়মকে ব্যাকরণ বলে। অথবা যে নিয়মে ভাষা সুন্দর, শুদ্ধ ও শৃংখলাবদ্ধ করা যায় এবং ভাষার স্বরূপ, প্রকৃতি ও প্রয়োগরীতি (ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব) সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায় তাকে ব্যাকরণ বলে।
ব্যাকরণ হলো ভাষারাজ্যের সংবিধান যা মেনে চলতে হয়। না মানলে শৃঙ্খলা জটে পড়ে-ভাষা পথ হারায়। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাকরণ হলো একটি ভাষা আমরা কীভাবে বলি তার নিয়মের সমষ্টি। কীভাবে উচ্চারণ করব তার নিয়ম, কীভাবে শব্দ তৈরি করব তার নিয়ম, শব্দকে জুড়ে কীভাবে পদবন্ধেরূপ দেব তার নিয়ম, আবার পদবন্ধ জুড়ে কীভাবে বাক্য নির্মাণ করব তার নিয়ম। এই নিয়মগুলো আগে থেকে তৈরি থাকে। প্রতিটি মানুষ যে ভাষার উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মায় শিশু অবস্থা থেকে তাকে এই নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে করতে এগোতে হয়। একসময় এই নিয়মগুলো তার মস্তিষ্কে সুশৃঙ্খলভাবে নিবন্ধ হয়ে যায়। এই মস্তিষ্কস্থিত ব্যাকরণই আমাদের কথা বলতে ও বুঝতে সাহায্য করে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: যে বিদ্যার দ্বারা কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরূপটি আলোচিত হয় এবং ভাষার পঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শদ্ধরূপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে। অথবা যে শাস্ত্রে কোন ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরূপ, প্রকৃতি ও প্রয়োগনীতি বুঝাইয়া দেওয়া হয়, সেই শাস্ত্রকে বলে সেই ভাষার ব্যাকরণ।
ড. সুকুমার সেন: কোন ভাষার উপাদান সমগ্রভাবে বিচার বিশ্লেষণ যে বিদ্যার বিষয় তাহাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।
ড. হুমায়ুন আজাদ: ব্যাকরণ বা গ্রামার বলতে বোঝায় এক শ্রেণির ভাষাবিশ্লেষণাত্মক পুস্তক যাতে সন্নিবিষ্ট হয় বিশেষ বিশেষ ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের সূত্রাবলি। বা ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের সূত্রাবলিকে ব্যাকরণ বলে।
D. H Sweet: Grammar is the practical analysis of language its anatomy.

বাংলা ব্যাকরণের পরিচয়
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ একদিনে তৈরি হয়নি। সংস্কৃত বাংলা ব্যাকরণের ভিত্তিভূমি হলেও কালক্রমে ইংরেজি ভাষার ব্যাকরণের প্রভাবও প্রবল। সংস্কৃত ও ইংরেজি ব্যাকরণবিদ সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষার দ্বারা বাংলা ব্যাকরণের রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন। যেমন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনি (‘অষ্টাধ্যায়ী’-দুইশত পঞ্চাশ বছর আগে রচিত), কত্যায়ন (বার্তিক), পতঞ্জলি (মহাভাষ্য) ও ভট্টোজি দীক্ষিতের (সিদ্ধান্তকৌমুদী) ব্যাকরণের সমন্বয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তৈরি করলেন ‘ব্যাকরণকৌমুদী’।
ব্যাকরণের সবগুলো নিয়ম একদিনে যুক্ত হয়নি। ১৮২০ সালে সন্ধিকে ব্যাকরণবদ্ধ করেন মথুরামোহন দত্ত। ১৮৫০ সালে সন্ধির বিস্তর ব্যবহার করেন শ্যামাচরণ সরকার। শুধু তাই নয়, ১৮৫৮ সালে তিনি সমাস (রামমোহন রায় সমাসের আলোচনা করেছিলেন নাম ছাড়া), লিঙ্গ, প্রত্যয়, ণত্ব-ষত্ববিধানও সংযুক্ত করেন। এর ওপর ব্যাকরণ সামগ্রিকভাবে আলোচনা করেন জয়গোপাল গোস্বামী ১৮৭৪ সালে। আর ব্যাকরণ পর্বে ছন্দ যোগ করেন ষাটের দশকে মধুসূদন শর্মা, অলংকার যোগ করেন রামগতি ন্যায়রত্ন ১৮৫৭ সালে। এর আগে ব্যাকরণ কৌমুদী-তে এসব পাওয়া যায় তবে সংক্ষেপ এবং পুরোটা সংস্কৃতের ছাঁচে গড়া। কৌমুদীতে উপসর্গ, অনুসর্গ ও প্রত্যয় আলোচনা হয় নাই। সংস্কৃত ও বাংলা ব্যাকরণ কী তা ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ পাঠ করলে পার্থক্য নির্ণয় করা যায়।
কখনও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য, কখনও ধর্মপ্রচার, কখনবা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে বহু বিদেশি জাতি ভারতবর্ষে এসেছে। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজের প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্যে বাংলা ভাষা সাহিত্যে-সংস্কৃতির চর্চা করেছেন। অষ্টাদশ শতকে আগত এইরকম কয়েকটি বিদেশি জাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ, ওলন্দাজ ইত্যাদি। এই সব জাতি এদেশের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার তাগিদে বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তখন ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তে ছিল এদের বড় ঘাঁটি। মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষা-সংস্কৃতি এদের প্রেরণা দিয়েছিল। যেহেতু এখানকার ভাষা ছিল বাংলা তাই বাংলা শিক্ষার জন্য ব্যাকরণ রচনার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। একদিকে ছিল নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য, অন্যদিকে খ্রিস্টধর্ম প্রচার। তাই সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে দেশীয় ভাষায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ ও প্রচার করা অনিবার্য হয়েছিল। এই জন্যে অবিভক্ত বাংলার ঢাকায় একটি ‘ফিরিঙ্গি-বাংলা-খ্রিস্টান সাহিত্য’ সূচনা হয়েছিল।

যে নিয়মের মাধ্যমে বাংলাভাষাকে সুন্দর, শুদ্ধ ও শৃংখলাবদ্ধ করা যায় সেই নিয়মকেই আমরা বাংলা ব্যাকরণ বলি।
ব্যাকরণবিদগণের মতে বাংলা ব্যাকরণের সংজ্ঞা
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯): যে শাস্ত্র জানিলে বাঙ্গালা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায়, তাহার নাম বাঙ্গালা ব্যাকরণ।
মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী: যে শাস্ত্রে কোনো ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতির স্বরূপের বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয়, তাকে ব্যাকরণ বলে।
ড. সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২): কোন ভাষার উপাদান সমগ্রভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ যে বিদ্যার বিষয় তাহাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে। বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতির বিচার ও বিশ্লেষণ এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে বলতে, লিখতে ও শিখতে পারা যায় তাকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ সংক্ষেপে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০২-১৯৮২): যে শাস্ত্রের দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া ইহার বিবিধ অংশের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায় এবং ভাষা রচনাকালে আবশ্যক মত সেই নির্ণীত তত্ত্ব ও তথ্য প্রয়োগ সম্ভবপর হইয়া উঠে, তাহার নাম ব্যাকরণ।
জ্যোতিভূষণ চাকী: যে ব্যাকরণ বাংলাভাষার ধ্বনি, শব্দ, পদ ও বাক্য ইত্যাদির বিশ্লেষণ করে ভাষার স্বরূপটিকে তুলে ধরে তাকেই আমরা বাংলা ব্যাকরণ বলতে পারি।

ব্যাকরণের প্রকরণ
নানানরকম বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে ব্যাকরণকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন:
১. বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ: এ জাতীয় ব্যাকরণে সাধারণত বিশেষ কোন কালে বা যুগে, কোন একটি ভাষার রীতি ও প্রয়োগ ইত্যাদি বর্ণনা করা এ ধরনের ব্যাকরণের বিষয়বস্তু এবং সেই বিশেষ কালের ভাষা যথাযথ ব্যবহার করতে সাহায্য করাই এই ব্যাকরণের উদ্দেশ্য।
২. ঐতিহাসিক ব্যাকরণ: কোন একটি ভাষার উৎপত্তি থেকে চলমান সময় বা বর্তমান কাল পর্যন্ত সে ভাষার ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করা এই ব্যাকরণের আসল লক্ষ্য।
৩. তুলনামূলক ব্যাকরণ: এই শ্রেণির ব্যাকরণ কোন বিশেষ সময়ের বিভিন্ন ভাষার গঠন, প্রয়োগরীতির তুলনামূলক আলোচনা করে থাকে তাকেই তুলনামূলক ব্যাকরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৪. দার্শনিক-বিচারমূলক ব্যাকরণ: ভাষার অন্তর্নিহিত চিন্তাপ্রণালি আবিষ্কার ও অবলম্বন করে সাধারণভাবে অথবা বিশেষভাবে ভাষারূপের উৎপত্তির বিবর্তন কিভাবে ঘটে তার বিচার করাই এই ব্যাকরণের মূল উদ্দেশ্য।
মনের ভাব প্রকাশের জন্য ব্যাকরণের প্রয়োজন হয় না তবে ভাষাকে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ অর্থাৎ সুন্দর, শুদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে ব্যাকরণের প্রয়োজন হয়। ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব অনেক।

বাংলা ব্যাকরণের বিষয়বস্তু বা পরিধি
ব্যাকরণের কাজ হলো ধ্বনি, বর্ণ, শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করা। ব্যাকরণের কাজের উপর তার পরিধি নির্ভর করে। ব্যাকরণের কাজ যেহেতু অনেক সেহেতু এর পরিধিও বিস্তৃত। যেমন:
ভাষাতত্ত্ব: ভাষার পরিচয়, বাংলা ভাষার পরিচয়, বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব, বাংলা ভাষার বিভিন্নরূপ।
ধ্বনিতত্ত্ব: ধ্বনি ও বর্ণ, বর্ণমালা ও লিপি, স্বরধ্বনি ও স্বরবর্ণের পরিচয়, ব্যঞ্জনধ্বনি ও ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয়, বাংলা উচ্চারণের নিয়ম, বাংলা বানানের নিয়ম।
রূপতত্ত্ব: শব্দ, শব্দভাণ্ডার, শব্দ বা পদের শ্রেণিবিভাগ, শব্দগঠনের উপায়।
বাক্যতত্ত্ব: বাক্য ও বাক্যের ধরন, বাক্য প্রকরণ, পদক্রম, উক্তি, যতি।
বাগর্থতত্ত্ব: অর্থ পরিবর্তন, অর্থের শ্রেণিবিভাগ, সমার্থক শব্দ, ভিন্নার্থক শব্দ, সমোচ্চারিত শব্দ ও প্রায়সমোচ্চারিত শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ, বাক্য সংকোচন বা এককথায় প্রকাশ, বাগধারা, প্রবাদ-প্রবচন, বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ।
নির্মিতি: অনুবাদ, অনুচ্ছেদ রচনা, দিনলিপি লিখন, অভিজ্ঞতা বর্ণনা, ভাষণ লিখন, প্রতিবেদন লিখন, বৈদ্যুতিন চিঠি (ই-মেইল) বা ক্ষুদেবার্তা লিখন, পত্র, আবেদনপত্র (জীবনবৃত্তান্ত সহ), মানপত্র লিখন, সারাংশ, সারমর্ম, সারসংক্ষেপ লিখন, ভাবসম্প্রসারণ, সংলাপ লিখন, ক্ষুদেগল্প লিখন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখন, প্রুফসংশোধন নির্দেশিকা।
এছাড়া ছন্দতত্ত্ব, অলংকারতত্ত্ব ও রসতত্ত্ব ব্যাকরণের আওতাভূক্ত।

ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব
ব্যাকরণের প্রয়োজন বা গুরুত্ব সম্পর্কে ড. এনামুল হক বলেছেন, ‘আলো, জল, বিদ্যুৎ, বাতাস প্রভৃতি সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য না জানিয়াও মানুষ বাঁচিয়াছে, বাঁচিতেছে ও বাঁচিবে। কিন্তু তাই বলিয়া ওই সমস্ত বস্তুর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যকে মানুষ অস্বীকার করিয়া বর্তমান সভ্যতার গগন বিচুম্বী সৌধ নির্মাণ করিতে পারে নাই। ব্যাকরণ না জানিয়াও ভাষা চলিতে পারে কিন্তু ভাষাগত সভ্যতা না হউক, অন্তত ভব্যতার পত্তন বা সমৃদ্ধি হইতে পারে না। এই জন্য শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে ব্যাকরণ সম্বন্ধীয় সাধারণ জ্ঞানের সহিত বিশেষ জ্ঞানও আবশ্যক।’ রাষ্ট্রের সকলের ব্যাকরণ পাঠ অবশ্যই প্রয়োজন। ব্যকরণ পাঠ বিভিনন্নে প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। যেমন :
ক) ভাষার গতিবিধি লক্ষ করে ভাষা বিশ্লেষণ করা যায় এবং সুন্দর, শুদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যায়।
খ) উচ্চারণ সঠিক এবং বানান প্রমিত করা যায়।
গ) ছন্দ ও অলংকারের সঠিক প্রয়োগ-পদ্ধতি শেখা যায়।
ঘ) সাহিত্যের ছন্দ, অলংকার ও রস সম্পর্কে জানা যায়।
ঙ) ভাষাকে শুদ্ধভাবে পড়তে, বুঝতে, লিখতে ও বলতে পারা যায়।
চ) ভাষার মৌলিক উপাদান—ধ্বনি, শব্দ ও বাক্যের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়।
ছ) ভাষার রূপ সম্পর্কে অর্থাৎ ধ্বনি, শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়।
জ) ভাষার মৌলিক অংশ বা বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপ নির্ণয়, গঠন ও প্রয়োগবিধি সম্পর্কে জানা যায়।
ঝ) বাক্যগঠন ও ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ানো যায়।
ঞ) সাহিত্যের দোষগুণ সম্পর্কে জানা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাকরণের কাজ বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন—‘বাংলাভাষার নিয়ম বাহির করিয়া লিপিবদ্ধ করাই ব্যাকরণের কাজ বা উদ্দেশ্য।’

Wednesday, 5 April 2017

ভিন্নার্থক শব্দ বা সমোচ্চারিত বা প্রায়সমোচ্চারিত শব্দ

ভিন্নার্থক শব্দ বা সমোচ্চারিত বা প্রায়সমোচ্চারিত শব্দ



যেসব শব্দের উচ্চারণ প্রায় এক কিন্তু বানান ও অর্থ ভিন্ন সেসব শব্দকে সমোচ্চারিত শব্দ বলে। অন্যভাবে বলা যায়, উচ্চারণে অভিন্ন এবং অর্থে ভিন্ন যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় তাকে সমোচ্চারিত শব্দ বলে।
লিখতে গেলে আমরা কিছু শব্দের বানান নিয়ে সংশয়ের মধ্যে থাকি। যেসব বানান প্রায় এক কিন্তু অর্থ আলাদা। জাদুর চুড়ি পরে সে প্রতিরাতেই চুরি করতে যায়। চুড়ির স্থান বদল হলে বাক্যের কী হাল হবে! এরা শুধু অর্থকেই ঠিকরাখে না, এরা বাক্যে বসে বাক্যকে সুন্দর ও অলংকারমণ্ডিত করে।

সমোচ্চারিত শব্দের প্রকরণ
১. সমধ্বনি: ণন, শ—ষ—স, উ—ঊ ইত্যাদি দ্বারা শব্দ গঠিত হতে পারে। যেমন: শোনা— সোনা।
২. সমরূপ : যার বানান ও উচ্চারণ এক কিন্তু অর্থ ভিন্ন। যেমন: চাল—চাল, উত্তর—উত্তর, মাথায়—মাথায়।

সমোচ্চারিত শব্দের প্রয়োজনীয়তা
সমোচ্চারিত শব্দ বিভিন্নভাবে বাক্যকে সাহায্য করে থাকে। সমোচ্চারিত শব্দ সঠিক বাক্য ও বাক্যের সঠিক অর্থ রক্ষা করা ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা রক্ষা করে। দেশীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে, বক্তৃতার বক্তব্য আকর্ষণীয় করতে, বাক্যকে অলংকারমণ্ডিত করতে, অর্থের বিপর্যয় থেকে বাক্যকে রক্ষা করতে, বাক্যের ভাব— অর্থ রক্ষা করতে, ভুল বানান থেকে রক্ষা করে এবং বাক্যে যমক অলংকার ব্যবহার করতে সাহায্য করে।

কতিপয় শব্দের নমুনা
সমোচ্চারিত শব্দ অর্থ       বাক্যরচনা
অন্ন   (ভাত)          — দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্ব গতিতে মানুষের মুখে অন্ন ওঠা দায়।
অন্য (অপর)         — সংস্কার, সংস্কার বাদ দিয়ে দুটো অন্য কথা বল।
অনু   (পশ্চাৎ)         — এই দেশে এক সময় স্ত্রীলোকদের মৃত স্বামীর চিতায় অনুগমন করতে হতো।
অণু   (ক্ষুদ্রতম অংশ)     — এটুকু ভাতে আমার পেটের অণুটুকুও ভরবে না।
অনিষ্ট (ক্ষতি)          — অন্যের অনিষ্টের চিন্তা কখনো মনে এনো না।
অনিষ্ঠ (নিষ্ঠাহীন)       — লেখা পড়ায় অনিষ্ঠ হলে পাশ করতে পারবে না।
অংশ (ভাগ)          — বাপের জমির অংশ মেয়েরাও ছাড়বে না।
অংস (কাঁধ)          — বিপদে দূরে সরে না থেকে অংস মেলাও।
অর্ঘ   (মূল্য)          — তোমার একাজের অর্ঘ দেওয়ার সাধ্য আমার নাই।
অর্ঘ্য (পূজার উপকরণ)   — মানুষের জন্য কাজ করলে তারা তোমার পায়ের কাছে অর্ঘ্য সাজাবে।
অশ্ব   (ঘোড়া)         — শুয়ে পড়ো, অশ্বের মতো দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ো না।
অশ্ম (পাথর)         — অশ্মে মাথা ঠুকে লাভ নাই, চল বাড়ি যাই।
অশক্ত (দুর্বল)          — বিপদে অশক্ত হতে নাই।
অসক্ত (আসক্তিহীন)      — বইয়ে অসক্ত হলে ছাত্রজীবন বৃথা হবে।

অনিল (বাতাস)         — গুমোট গরমে অনিল এসে প্রাণ জুড়াল।
অনীল (যা নীল নয়)     — আকাশ কী কখনো অনীল হয়।
অভ্যাস      (বারবার চেষ্টা)— পরীক্ষা কাছে রাত জেগে পড়ার অভ্যাস করো।
অভ্যাশ      (নিকট)    — অংক অভ্যাস কর, পরীক্ষা অভ্যাশে।
১০
অবধ্য (বধের অযোগ্য)    — মানুষ মানুষের অবধ্য।
অবোধ্য (যা বোঝা যায় না) — অবোধ্য তত্ত্ব কথা সব জায়গায় বল না।
১১
অপরিণত (যা পরিণত হয়নি) — অপরিণত বয়সে এ বই পড়ে কিছুই বুঝবে না।
অপরিণীত (অবিবাহিত)    — বিধবার ঘরে অপরিণীত দুটো মেয়ে আছে।
১২
অন্ত   (শেষ)          — সংসারে কাজের অন্ত নাই।
অন্ত্য (যা অন্তে আছে)    — অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া শেষেই মানুষের শোক নিঃশেষ হয়ে যায়।
১৩
অন্যন্য      (অপরাপর) — অন্যন্যের সঙ্গেই তার ভাল সম্পর্ক আছে।
অন্যোন্য (পরস্পর)       — অন্যোন্যের প্রতি ভালোবাসায় মানুষের সুখ।
১৪
অন্নপুষ্ট (ভোজনপুষ্ট)      — এ আকালে অন্নপুষ্ট মানুষ নাই।
অন্যপুষ্ট (কোকিল)       — কাকের বাসায় কোকিলের ছা অন্যপুষ্ট হয়।
১৫
অবদান (সৎকর্ম)        — মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য।
অবধান (মনোযোগ)      — স্বাধীনদেশের মান বাড়াতে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিতে অবদান দিতে হবে।
১৬
অবিরাম (অনবরত)      — অবিরাম চেষ্টা মানুষকে সফলতা এনে দেয়।
অভিরাম (সুন্দর)        — পোশাকে নয়নাভিরাম সেজো না, মনের দিকে অভিরাম হও।
১৭
অপচয়      (ক্ষতি)          — সময়ের অপচয় করলে জীবন নষ্ট হয়।
অবচয়      (চয়ন)          — সবকিছুতেই সৌন্দর্য অবচয়ন করতে হবে।
১৮
অবিনীত (উদ্ধত)   — অবিনীত সন্তান মা—বাবার মর্যাদা নষ্ট করে।
অভিনীত (অভিনয় করা হয়েছে)— অনেক সময় নাট্যদলের অভিনীত মঞ্চনাটক দর্শকের মনে আশা জাগায়।
১৯
অজগর (সাপ)     — অজগর অলস প্রকৃতির।
অজাগর (নিদ্রা)    — মা অজাগর ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে।
২০
অপগত (দূরীভূত)   — অপরের দুঃখ অপগত করতে জীবন বিলিয়ে দাও।
অবগত (জানা)    — দেশসেবা করতে চাইলে দেশ সম্পর্কে অবগত হওয়া চাই।
২১
আদি (মূল)      — চর্যাপদ বিাংলার আদি ভাষা।
আধি (মনঃকষ্ট)   — আধি গোপন না করে খোলা মেলা আলোচনা করা ভালো।
২২
আশা (ভরসা)    — ছাত্রদের উপর দেশের মানুষের অনেক আশা।
আসা (আগমন)   — আজ তার বাড়িতে আসা হবে না।
২৩
আবাস      (বাসস্থান)   — ঢাকা শহরে অনেক মানুষের আবাস নাই, তারা ফুটপথে থাকে।
আভাস (ইঙ্গিত)    — পুলিশের আভাসেই চোরটা পালিয়ে গেল।
২৪
আবরণ (আচ্ছাদন) — ছাতার আবরণে রোদ— বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
আভরণ (অলংকার) — আভরণের লোভ দেখিয়ে মেয়েদের ঘরে আটকিয়ে রাখা যাবে না।
২৫
আপন (নিজ)     — আপন কাজে কেউ ফাঁকি দেয় না।
আপন (দোকান)   — আপন থেকে লবণ কিনে আনো।
২৬
আষাঢ় (মাস বিশেষ) — বাংলাদেশে আষাঢ়ে প্রচুর বৃষ্টি হয়।
আসার      (প্রবল বৃষ্টিপাত)— আসার বন্যার অন্যতম কারণ।
২৭
উপাদান (উপকরণ) — আমাদের দেশে কৃষি উপাদান সহজলভ্য।
উপাধান (বালিশ)   — উপাধানে মাথা রেখে ঘুমাও।
২৮
ওষধি (যে গাছ একবার ফল দিয়ে মারা যায়)— ধান ওষধি গাছ।
ওষধি (ভেষজ উদ্ভিদ) — ওষধির পর্যাপ্ত চাষ বাংলাদেশের জন্য জরুরি।
২৯
কূল   (তট)      — নদিকূলে বসে সূর্যাস্ত দেখতে ভালো লাগে।
কুল   (বংশ)     — উঁচুকুল জন্মালেই ভালো মানুষ হওয়া যায় না।
৩০
কাক  (পাখি বিশেষ) — কাক কালো হয়।
কাঁখ (কোমর)    — কাঁখে কলসি গ্রামীণ বধূর প্রাচীন ছবি।
৩১
কালি (লেখার রং)      — কালো কালিতে ভালো লেখা হয়।
কালী (সনাতন ধর্মের দেবী) — কালী শক্তির প্রতীক।
৩২
ক্রীত (কেনা হয়েছে যা)   — শ্রমিকেরা ক্রীতদাস নয়।
কৃত   (করা হয়েছে যা)   — প্রত্যেক মানুষ নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করে।
৩৩
কপাল  (ললাট)         —কপাল ভালোমন্দ বলে কিছু নাই কাজ করলে ফল লাভ করা যায়।
কপোল      (গণ্ডদেশ)        — জ্বর এলে কপোলে হাত দিয়ে তাপমাত্রা বোঝা যায়।
৩৪
খাট   (পালঙ্ক)         — খাটতো দূরের কথা আমাদের দেশে বহু মানুষের ঘরই নাই।
খাটো (বেঁটে)          — আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ খাটো প্রকৃতির।
৩৫
খুর   (পশুর পায়ের তলদেশ) — গরুর খুরের নিচে পা পড়লে মানুষের পা থেতলে যায়।
ক্ষুর   (চুল দাড়ি কামাবার অস্ত্রবিশেষ)—এখন ক্ষুরের চেয়ে বে¬ড দিয়েই বেশি মানুষ শেভ করে।
৩৬
গা    (শরীর)         — কৃষকের গা রোদে পুড়ে তামাটে হয়।
গাঁ    (গ্রাম)          — গাঁয়ের মানুষ সহজসরল হয়।
৩৭
গাদা (রাশি, স্তুপ)      — কৃষক ধান কেটে গাদা দিয়েরাখে।
গাধা (গর্ধভ)         — গাধার সামনে মূলা ঝুলিয়ে ভারটানা সহজ।
৩৮
গোকুল      (বৃন্দাবন)   — কৃষ্ণ গোকুলে বাঁশি বাজায়।
গোকুল      (গরুজাতি) — গোকুল আমাদের গৃহপালিত পশু।
৩৯
ঘোড়া (অশ্ব)          — ঘোড়ার গায়ে শক্তি বেশি।
ঘোরা (বিচরণ)        — রোদে বেশি ঘোরাঘুরি করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
৪০
চাখড়ি (খড়িমাটি)       — চাখড়ি দিয়ে কাপড়ে দাগকাটা যায়।
চাকরি (বেতনের বিনিময়ে কাজ)— চাকরিতে স্বাধীনতা নাই।
৪১
চাল   (ঘরের চালা)      — গ্রামেও এখন আর খড়ের চালের প্রচলন নাই।
চাল   (চাউল)         — চালের বাজারে এখন সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই।
৪২
চির   (দীর্ঘকাল)        — চিরদিন কেউ বেঁচে থাকে না।
চীর   (ছেঁড়া কাপড়)     — চীর হলেও পরিষ্কার করে পরতে হয়।
৪৩
ছার   (অধম)         — সে আবার কোন ছার, তাকে কুর্নিশ করতে হবে।
ছাড় (অনুমতি)        — অশালীন সিনেমা প্রদর্শণীয় ছাড়পত্র বাতিল করতে হবে।
৪৪
ছাদ   (আচ্ছাদন)       — ছাদে উঠলেই চাঁদে যাওয়া যায় না।
ছাঁদ   (আকৃতি, গঠন)    — পৃথিবীতে নানা ছাঁদের মানুষ দেখা যায়।
৪৫
জল   (পানি)          — জলের কোন রং নেই।
জ্বল   (দীপ্তি)          — রাতে ঝোপে ঝোপে জোনাকির আলো জ্বলজ্বল করে।
৪৬
জাম (ফলবিশেষ)      — পাকা জামের রস মধুর।
যাম   (অংশ)          — দিবসের দ্বিতীয় যামে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
৪৭
জিব (জিহ্বা)          — কুকুরের জিব দিয়ে লালা পড়ে।
জীব (প্রাণী)          — বুদ্ধির জোরেই জীব জগতে মানুষ শ্রেষ্ঠ।
৪৮
জ্যোতি (আলো)         — চাঁদের নিজের কোন জ্যোতি নাই।
যতি (ছেদ)          — কাজে যতি দেওয়া মানে কাজবন্ধ করা নয়।
৪৯
টিকা (রোগের প্রতিষেধক) — টিকা দিলে অনেক রোগের আক্রমন থেকেরক্ষা পাওয়া যায়।
টীকা (ব্যাখ্যা)         — অবোধ্য লেখায় টীকা টিপ্পনি জুড়ে স্পস্ট করতে হয়।
৫০
টেকা (সয়ে থাকা)      — দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গরিব মানুষের টেকা দায়।
টেক্কা (প্রতিযোগিতা)     — হস্তশিল্প যন্ত্রশিল্পের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে টিকতে পারে না।
৫১
ঠক   (ধ্বনিবিশেষ)      — ঠকঠক শব্দ করে সে অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে চলে।
ঠক   (প্রতারক)        — ঠক মানুষকে কেউ শ্রদ্ধা করে না।
৫২
ডোল (ভাণ্ড)               — ডোলে ধান চাল রাখা হয়।
ঢোল (বাদ্যযন্ত্র)        — ঢাক ঢোল বাজিয়ে আসর জমিয়ে নিলো।
৫৩
ডাল (শাখা)          — ঝড়ের সময় গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে।
ডাল (খাদ্যবিশেষ)      — গরিবের ডালভাত খেয়ে দিন কাটে।
৫৪
ঢাল   (আঘাত প্রতিরোধ করার অস্ত্র)—ঢাল দিয়ে সে তীরের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করল।
ঢাল   (ঢালু জমিবিশেষ)   — পাহাড়ের ঢালে ঢালে জুম চাষ হয়।
৫৫
দিন   (দিবস)         — দিন যেয়ে রাত আসে।
দীন   (দরিদ্র)         — দীনে দয়া করা মানুষের ধর্ম।
৫৬
দেশ   (ভূখণ্ড)         — অনেক শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে।
দ্বেষ   (হিংসা)         — দ্বেষ মানুষকে ধবংস করে।
৫৭
দীপ   (আলো)         — মঙ্গলদীপ জ্বালিয়ে শুভ কামনা করা হয়।
দ্বীপ   (জলবেষ্টিত স্থলভাগ) — ভোলা বাংলাদেশের বৃহত্তম বদ্বীপ।
৫৮
ধনী   (বিত্তশালী)       — ধনী মানুষের ধনের লোভ অপরিসীম।
ধ্বনি (আওয়াজ)       —১৯৭১ সালে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি রাজাকারদের আতঙ্কিত করে তুলত।
৫৯
ধরা   (পৃথিবী)         — ধনে ধান্যে ভরা আমাদের এই ধরা।
ধড়া (কটি বস্ত্র)      — ধড়া পরে তাকে অসহায় মনে হচ্ছে।
৬০
ধাতৃ (বিধাতা)        — মানুষের মাঝেই ধাতৃ নিজেকে লুকিয়ে রাখেন।
ধাত্রী (দাই)          — ধাত্রী মা শিশুটিকে লালনপালন করেন।
৬১
নীর   (পানি)          — বানের নীর মানুষের দুঃখের কারণ।
নীড় (পাখির বাসা)     — কোকিল নীড় বানাতে পারে না।
৬২
নিতি (রোজ)         — নিতি দিন তোমার কাছে আমার প্রার্থনা।
নীতি (নিয়ম)         — দেশ পরিচালনার নীতিই রাজনীতি।
৬৩
নিত্য (প্রতিদিন)        — সে নিত্য এখানে আসা যাওয়া করে।
নৃত্য (নাচ)          — ছোট শিশুটির নৃত্য সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
৬৪
নিরাশ (আশাহীন)       — নিরাশ মানুষকে সফল হতে দেয় না।
নিরাস (প্রত্যাখ্যান)       — দুর্নীতিকে মানুষ নিরাস করেছে।
৬৫
নিরস্ত্র (অস্ত্রহীন)— ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর গুলি চালিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্য।
নিরস্ত (ক্ষান্ত)     — শহিদ হয়েছে তবু যুদ্ধে বাঙালি নিরস্ত হয়নি।
৬৬
প্রদান (দেওয়া)    — ভিয়েতনাম সরকার দুজন বাংলাদেশিকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি প্রদান করেছে।
প্রধান (বড়, শ্রেষ্ঠ) — ভাত বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য।
৬৭
পরা   (পরিধান)        — আদিম মানুষ কাপড় পরত না।
পড়া (পাঠ করা)       — বই পড়া মজার কাজ।
৬৮
পান   (পাতা বিশেষ)     — পাহাড়ে পানের চাষ ভালো হয়।
পান   (পান করা)       — ধূমপান বদ অভ্যাস।
৬৯
প্রসাদ (অনুগ্রহ)        — প্রসাদ নয়, গরিবকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে।
প্রাসাদ (বড় দালান)      — ঢাকা শহরে প্রাসাদের অভাব নাই।
৭০
পালক (পাখির ডানার অংশ) — পালক পাখিকে শীত ও তাপ থেকে রক্ষা করে।
পলক  (মুহূর্ত, অল্প সময়)      — পারমাণবিক বোমা এক পলকে আমাদের পৃথিবীকে ধবংস করে দিতে পারে।
৭১
পরভৃত      (কোকিল)   — বসন্তে পরভৃত ডাকে।
পরভৃৎ      (কাক)     — পরভৃৎ কাকা করে।
৭২
ফি   (প্রত্যেক)        — ফিবছর আমরা নববর্ষ উদযাপন করি।
ফি   (বেতন)         — ফি বৃদ্ধি করে শিক্ষাকে পণ্য বানানো হচ্ছে।
৭৩
বর্ষা   (ঋতুবিশেষ)      — বর্ষাকালে মাঠঘাট পানিতে ভরে যায়।
বর্শা   (অস্ত্রবিশেষ)      — বর্শার আঘাতে মানুষের মৃত্যু হয়।
৭৪
বান   (বন্যা)          — বানভাসী মানুষের পাশে দাঁড়াও।
বাণ   (শর)          — বানবিদ্ধ হরিণ শাবক ছটফট করতে করতে মারা গেল।
৭৫
বল   (শক্তি)          — খাদ্য শরীরের বল বৃদ্ধি করে।
বল   (খেলার বল)      — চার বছর পরপর বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
৭৬
বিনা (ব্যতীত)        — বিনা কারণে কার্য হয় না।
বীণা (বাদ্যযন্ত্র)        — বীণার সুরে মানুষ আনন্দ পায়।
৭৭
বিষ   (গরল)          — আর্সেনিক এক প্রকার বিষ।
বিশ   (কুড়ি)          — বিশ টাকায় এখন এক কেজি আলুও কিনতে পাওয়া যায় না।
৭৮
ভাষণ (উক্তি, কথন, বক্তব্য) — মিথ্যা ভাষণে মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।
ভাসন (দীপ্তি)          — সূর্যের আলয় সোনা ভাসন ছড়ায়।
৭৯
ভারা (স্তূপাকার)        — ধান কাটা শেষে চাষিরা ভারা করে রাখে।
ভাড়া (মাশুল)         — এখন বাসের ভাড়াও মানুষের অসহনীয়।
৮০
মন   (অন্তর, হৃদয়)     — মনই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
মণ   (চল্লিশ সের)      — পরিমাপের জন্য এখন আর মণ ব্যবহার করা হয় না।
৮১
মাস   (ত্রিশ দিন)      — বারমাস সে এখানে থাকে।
মাষ   (কলাই)         — মাষকলাই ডাল খেতে ভালো।
৮২
মুখ   (বদন)     — পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিতে ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে।
মুক   (বোবা)         — মুক মানুষ কথা বলতে পারে না।
৮৩
মরা   (মৃত)          — মরা মানুষ পানিতে ভেসে ওঠে।
মড়া (শবদেহ)        — মড়াকে তাড়াতাড়ি সৎকার করাই ভালো।
৮৪
মূর্খ   (জ্ঞানহীন)       — মূর্খ মানুষের কান্ডজ্ঞান থাকে না।
মুখ্য   (প্রধান)         — মেধা নয়, টাকাই শিক্ষা গ্রহনের জন্য মুখ্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে এখন।
৮৫
মোড়ক      (আচ্ছাদন)   — বিজ্ঞাপনের মোড়কে পন্যের গুণ বোঝা যায় না।
মড়ক (মহামারি)        — আগে মড়ক লেগে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত।
৮৬
যোগ্য (উপযুক্ত)        — মন্ত্রীর ছেলে চোর যোগ্য বাপের যোগ্য পুত্র বটে।
যজ্ঞ   (যাগ, উৎসব)     — বিজয় দিবস বাঙালিদের মিলনযজ্ঞ।
৮৭
রচক (রচয়িতা)        — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচক।
রোচক (উপভোগ্য)      — মুখরোচক হলেই খাদ্য পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হয় না।
৮৮
রাধা (রাধিকা)        — রাধা কৃষ্ণের লীলা বৈষ্ণব মতে ভগবত লীলা।
রাঁধা (রন্ধন করা)      — যে ভাতরাঁধে সে চুলও বাধে।
৮৯
লক্ষ   (সংখ্যা বিশেষ)     — লক্ষ লক্ষ মানুষ মাঠে নেমেছে।
লক্ষ্য (দৃষ্টি, উদ্দেশ্য, গন্তব্যস্থল) — স্বাধীনতা পরবর্তী সংবিধানই আমাদের লক্ষ।
৯০
লব্ধ   (লাভ করা)      — জ্ঞানলব্ধ মানুষ পথ চিনতে ভুল করে না।
লুব্ধ   (আকৃষ্ট)         — মানুষের পোশাক দেখে অনেকেই লুব্ধ হয়।
৯১
লক্ষণ (চিহ্ন)          — নিয়মিত লেখাপড়া করা ভালো ছাত্রের লক্ষণ।
লক্ষ্মণ (রামের ভাই)     — রাম লক্ষ্মণ সহোদয়।
৯২
শক্ত   (কঠিন)         — কাদা মাটি নরম হলেও গুড়িয়ে ইট শক্ত হয়।
সক্ত   (আসক্ত)         — মাদকাসক্ত সন্তান মা— বাবার কষ্টের কারণ।
৯৩
শয্যা (বিছানা)        — শয্যা বিছিয়ে সে ঘুমিয়ে গেলো।
সজ্জা (সাজ)          — বর সজ্জায় তাকে বেশ মানিয়েছে।
৯৪
শীত (শীতল)         — উত্তরবঙ্গে শীত বেশি পড়ে।
সিত (সাদা)          — সিত কাগজে ইচ্ছামত লেখা হয় না।
৯৫
শব   (মৃতদেহ)        — সব ধর্মেই শব সৎকারের কথা আছে।
সব   (সকল)         — সব মানুষের মুখে ভাত যোগানোর দায়িত্ব সরকারের।
৯৬
শিকার      (মৃগয়া)         — শিকার করা অনেক মানুষের শখ।
স্বীকার      (মেনে নেওয়া)     — ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্য পরাজয় স্বীকার করে।
৯৭
সর্গ   (অধ্যায়)        — বইটি পাঠ সর্গে সাজানো।
স্বর্গ   (বেহেশত)        — মাতৃভূমি মানুষের কাছে স্বর্গের সমান।
৯৮
সহিত (সঙ্গে)          — পণ্যের সহিত ফ্রি দেওয়া বিক্রয় কৌশল।
স্ব—হিত (নিজ কল্যাণ)    — পাগলেও স্ব-হিত বোঝে।
৯৯
সাড়া (সংকেত)        — বিড়ালের সাড়া পেয়ে ইঁদুরটি পালিয়ে গেল।
সারা (সমাপ্ত)         — কাজ সারা হলেই ঘরে ফিরব।
১০০
সাক্ষর (শিক্ষিত, অবদান) — আমাদের দেশে সাক্ষর মানুষ কম।
                      /সাহিত্যে তিনি সাক্ষর রেখেছেন।
স্বাক্ষর (নামসই)        — আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই স্বাক্ষর করতে জানে না।
১০১
হুতি (হোম)          — পুরোহিত অগ্নিতে সৃতাহুতি দিয়ে মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন।
হূতি   (আহবান)        — শ্রমিক অহূতিতে আগামিকাল ধর্মঘট।
১০২
হাড়   (অস্তি)     — হাড়ই সম্বল, তার শরীরে মাংস নাই বললেই চলে।
হার   (পরাজয়)   — প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে হার মানতেই হয়।
১০৩
হাঁস   (হংস)     — হাঁস পানিতে সাতাঁর কাটে।
হাস   (হাসি)     — হাসতে পারলে মন ভালো থাকে।